মৃতের জন্য চল্লিশা করা না করা
|
মমিনুল ইসলাম মোল্লা : কিছুদিন আগে
আমার
এক
আÍীয় মারা গেছেন। মৃত্যুর আগে
তিনি
বেশ
কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। ছেলেমেয়েদের ব্যস্ততার কারণে তার
সেবা-শুশ্রƒষা সঠিকভাবে হয়নি। তার
স্বামীও মারা
গেছেন। মারা
যাওয়ার আগে
স্ত্রীর
নামে
তাকে
কিছু
সম্পত্তি দিয়ে
গেছেন। তিনি
যখন
যে
সন্তানের তত্ত্বাবধানে থাকতেন তখন
সে
সন্তান সম্পত্তিটুকু ভোগ
করত।
তিনি
জীবিত থাকতে ওষুধ
ও
খাদ্যে কষ্ট
পেলেও তা
নিয়ে
কারও
কোন
মাথাব্যথা নেই;
তিনি
মারা
যাওয়ার পর
ছেলেমেয়েরা সে
সম্পত্তিটুকু বিক্রি করে
এলাকাবাসীকে ভূরিভোজ করালেন। চল্লিশা বা
কুলখানি উপলক্ষে এ
ধরনের ভোজ
উৎসব
আমাদের দেশে
(বিশেষ করে
গ্রামাঞ্চলে) প্রতিদিনই কোথাও না
কোথাও হচ্ছে। এখন
প্রশ্ন হচ্ছে, কেউ
মারা
গেলে
তার
আÍার মাগফিরাতের জন্য
এ
ধরনের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করা
কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? কেউ
কেউ
কিস্তিতে বা
সুদে
টাকা
এনেও
এ
ধরনের অনুষ্ঠান করছেন। যা
মোটেও শরীয়তসম্মত নয়।
আমাদের দেশের অধিকাংশ মুসলমানের পূর্বপুরুষ হিন্দু ছিল। তারা কোন না কোন সময় ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছেন। হিন্দুদের মধ্যে কেউ মারা গেলে নির্দিষ্ট দিনে এলাকাবাসীকে ভোজন করার সিস্টেম চালু রয়েছে। কোন কোন সময় ভিক্ষা করেও শ্রাদ্ধের টাকা সংগ্রহ করতে দেখা যায়। হিন্দুদের এ সিস্টেম মুসলমানদের ধর্মীয় কালচারে ঢুকে গেছে বলে মনে করা হয়। বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে কেউ মারা গেলে দাফন-কাফনের পর মুরব্বিগণও মৃতের ছেলে অথবা তার অভিভাবকরা একত্রে বসেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন কবে ৩ বা ৫ দিনের দোয়া পড়ানো হবে, কবে ৪০ দিনের বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হবে, কখন হাফেজ সাহেবদের দিয়ে কোরআন খতম করানো হবে। এছাড়া কখন মিলাদ পড়ানো হবে? ৩ বা ৫ দিনের অনুষ্ঠানে সাধারণত শুকনো খাবার চিঁড়া-মুড়ি, ফল-মূল, ইত্যাদি পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। কোন কোন সময় দেখা যায়, কেউ মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গেই স্থানীয় এতিমখানায় কোরআন খতম করার জন্য হাফেজ চেয়ে সংবাদ পাঠনো হয়। এতিমখানার প্রধান হাফেজ সাহেব ৩০টি অংশ ৩০ হাফেজের (ছাত্র) হাতে দিয়ে সে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তারা ঘণ্টা-দুঘণ্টার মধ্যেই সমস্বরে কোরআন খতম সম্পন্ন করে। হাফেজ ছাত্ররা এত দ্রুত কোরআন শরিফ পড়েন যে কারও পক্ষে কোরআন শরিফের আয়াতগুলো বোঝা সম্ভব হয় না। যারা পড়ছে তারাও এর অর্থ অনুধাবনের চেষ্টা করেন না। অথচ কোথাও কোরআন তিলাওয়াত হলে সবাই চুপ করে শোনার নিয়ম রয়েছে। তারা তাড়াহুড়ো করে তাদের দায়িত্ব পালন করে তাড়াতাড়ি মোনাজাত করে বিদায় নেন। এভাবে কোরআন পাঠ করার কোন বিধান নেই। এছাড়া মানুষ মারা যাওয়ার সময় নাপাক অবস্থায় থাকে। তাই তার সামনে বসে তার উদ্দেশে কোরআন তিলাওয়াত করার কোন সার্থকতা নেই। বর্তমানে কোন কোন জায়গায় জীবিত থাকতেই চল্লিশা বা কুলখানির অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার সংবাদ পাওয়া যায়। এমনই একজন গোপালগঞ্জের ১২৬ বছর বয়সী আছিয়া খাতুন। তার ছেলেমেয়েরা বলেন, মায়ের ইচ্ছা পূরণের জন্যই গ্রামের সবাইকে দাওয়াত করা হয়। এতে হিন্দু-মুসলমান সবাই সমঃস্বরে অংশগ্রহণ করে। খাদিজা খাতুন বলেন, আমার মৃত্যুর পর ছেলেমেয়েরা কী করবে না করবে বিশ্বাস নেই, তাই পরিবারের সম্মতি নিয়ে কুলখানি পালন করি। আমাদের সমাজের অধিকাংশ লোক মা-বাবা জীবিত থাকতে তাদের যতœ নেন না অথচ তারা মারা যাওয়ার পর তাদের উপলক্ষে খাওয়ার উৎসবের জন্য অধিক অর্থ ও শ্রম ব্যয় করেন। অথচ পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, পিতা-মাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার কর। যদি তোমাদের কাছে তাদের যে কোন একজন অথবা উভয়ই বৃদ্ধ অবস্থায় থাকে তাহলে তাদের কেউ উহ পর্যন্ত যেন না করে এবং তাদের মর্যাদাসহকারে কথা বল আর দয়া ও কোমলতাসহকারে তাদের সামনে বিনম্র থাক। অনেকের ধারণা, কোন লোক মারা গেলে ৪০ দিন তার আÍা বাড়ির আশপাশে ঘুরতে থাকে। চল্লিশা পালন করলে তার আÍা শান্ত হয়ে কবরে অবস্থান করে। কুলখানি বা চল্লিশা এমন এক কাজ যা শুধু বিদআতই নয়; অন্য ধর্মের অনুকরণও। অথচ রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘যারা অমুসলিম জাতির অনুসরণ করে তারা ওদের দলভুক্ত (আবু দাউদ)। কোরআন-হাদিসের কোথাও এ ব্যাপারে কোন নির্দেশনা না থাকলেও সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এতে সায় দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের কথা একটাই, আমাদের বাপ-দাদারা পালন করে গেছেন তাই আমরাও পালন করছি। এ ব্যাপারে সূরা বাকারার ৭নং আয়াতের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তারা বলে আমাদের বাপ-দাদাদের যা করতে দেখেছি আমরা তাই করব। কিংবা এরা কি সেই লোক? তাদের জন্য সমান তোমরা তাদের সতর্ক কর বা না কর, তারা মেনে নেবে না। আল্লাহ তাদের হƒদয় ও কানে মোহর মেরে দিয়েছেন। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তোমরা জাফরের পরিবারের জন্য খাবারের ব্যবস্থা কর। কেননা তার মৃত্যুর কারণে তারা শোকাহত (তিরমিজি)। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ওলামা কেরামগণ বলেন, মৃত ব্যক্তির পরিবারের জন্য প্রতিবেশী ও আÍীয় স্বজনের খাবারের ব্যবস্থা করা উচিত। কিন্তু মৃত ব্যক্তির পরিবার বা অন্য আÍীয়স্বজনের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা বিদআত। হাদিসে আছে, এক ব্যক্তি এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ আমার মা মারা গেছেন। এখন তার জন্য আমি কী করব? রাসূল বললেন, তোমার মায়ের জন্য দোয়া কর এবং তার আÍীয়স্বজনের সঙ্গে ভালো ব্যবহার কর। তার ওয়াদাকৃত ওসিয়ত পূরণ কর, দেনা থাকলে পরিশোধ কর। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রাঃ) মারা গেলে তার পুত্র আবদুল্লাহ ইবনে ওমর এক বেদুইন পল্লীতে গিয়ে এক বৃদ্ধ লোকের সঙ্গে দেখা করে বলেন, আমি ওমর পুত্র । বাবা জীবিত থাকতে বাবার সঙ্গে এসেছিলাম, বাবা মারা গেছেন, আপনি আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। বাবার হক আদায়ের জন্য আপনার কাছে এসেছি। বাবার জন্য দোয়া করবেন। বৃদ্ধ তাকে আলিঙ্গন করে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন এবং দোয়া করলেন। অথচ আমাদের কারও স্ত্রী মারা গেলে শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেই, বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত আÍীয় কিংবা বন্ধুবান্ধবদের কোন খোঁজখবর রাখি না। অর্থাৎ আমাদের যা করতে বলা হয়েছে তা না করে উল্টো কাজ করছি। হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর স্ত্রী খাদিজা মারা গেলে নবীজী চোখের পানি ফেলে দোয়া করেন, তার আÍীয়স্বজন ও বান্ধবীদের খোঁজ নিতেন, তাদের কাছে উপঢৌকন পাঠাতেন। কোরআন শরিফে পিতামাতার জন্য যে দোয়া করতে বলা হয়েছে সেটি হচ্ছে, ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা’ অর্থাৎ হে আল্লাহ আমার বাবা-মাকে তুমি তেমনি আদরে রাখ যেমন আদর যতেœ শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছে। সমাজের কেউ কেউ ইবাদত মনে করে কুলখানির আয়োজন করে। আবার কেউ কেউ লোকলজ্জার ভয়ে কুলখানির আয়োজন করে। এ ধরনের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে স্থানীয় মৌলভীগণ বিশেষ করে ‘কাটমোল্লাগণ’ প্রধান ভূমিকা পালন করেন। কারও বাবা মারা গেলে তিনি প্রথমে স্থানীয় মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে যান। তাকে বলেন, হুজুর আমি তো শেষ হয়ে গেলাম। আমি এখন কী করব? হুজুর বলেন, জীবিত থাকতে তুই তো মনে হয় তোর বাবার খেদমত সঠিকভাবে করতে পারিসনি। তোর বাবার আÍার মাগফিরাতের জন্য চল্লিশ জন হুজুর ডেকে নিয়ে এলাকাবাসীকে ভালোভাবে খাওয়ানোর ব্যবস্থা কর। তাহলে তোর বাবার আÍা শান্তি পাবে। এভাবেই চল্লিশা বা কুলখানি টিকে আছে যা জঘন্য বিদআত। ভক্তি সহকারে বিদআত পালন করে কী নবীজীর সাফায়াত পাওয়া যাবে? নাকি শেষ পর্যন্ত মিলবে ‘সহকান-সহকান’ দূর হয়ে যাও, দূর হয়ে যাও। হিন্দু সমাজ থেকে আমদানি করা এবং কুসংস্কারবাদী ধর্মীয় লোকদের সমর্থিত এসব বিদআতি অনুষ্ঠান থেকে দূরে থেকে আল্লাহ আমাদের সত্য বোঝা এবং আমল করার তৌফিক দিন। আমিন |
No comments