দ্বীনী ইলম লাভে প্রতিবন্ধকতা দূর করার উপায়
দ্বীনী ইলম লাভে প্রতিবন্ধকতা দূর করার উপায়
মমিনুল ইসলাম মোল্লা,আমরা মুসলমান। ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে জানতে হলে অবশ্যই ধর্মীয় জ্ঞান লাভ করা উচিত। অন্যান্য পার্থিব বিষয়ে জানার জন্য আমরা যতটুকু সময় দেই। পরকালীন ব্যাপারে জানার জন্য আমরা সে সময় দিতে পারি না। এক্ষেত্রে আমাদেরকে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়। প্রথমত শয়তান আমাদেরকে ধর্মীয় জ্ঞান লাভে নিরুৎসাহিত করে, যতটুকু জানি তা যদি মানতে পারি তাহলে সমস্যা আছে এ অজুহাতে অনেকে অতিরিক্ত জানতে চাননা, তাছাড়া পরিবার-পরিজন, স্ত্রী-সন্তানকে অতিরিক্ত সময় দেয়ার জন্য ধর্মীয় বই-পুস্তক পড়া হয় না, বাড়ির পাশে ধর্মীয় সমাবেশ হলেও আমরা অনেকেই তাতে অংশ গ্রহণ করিতে পারিনা, অথচ এ ধরণের সমাবেশ থেকেই আমরা হেদায়েতের বানী শুনতে পারতাম। বোখারি শরিফে বর্ণিত, আবু ওয়াজেদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, একদিন রাসুল (সাঃ) মসজিদে বসে সাহাবীগণের উদ্দেশ্যে দ্বীনী এলেম নিয়ে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় ৩ জন লোক এস একজন সম্মুখে যায়গা পেয়ে বসল। অন্যজন কাউকে বিরক্ত না করে পেছনে বসল। তৃতীয়জন স্থান সঙ্কটের জন্য চলে গেল। মজলিস শেষে রাসুল (সাঃ) মন্তব্য করলেন, প্রথমজন আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য তৎপর হওয়ায় আল্লাহ তাকে নিকটেই স্থান করে দিলেন। তৃতীয় ব্যক্তি ফিরে চলে যাওয়ায় আল্লাহও তাকে ( এই মজলিসের শিক্ষা ও বরকত .হতে) মাহরুম করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি ইলম অর্জনের চেষ্টা করে তার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। আল্লাহ তার জন্য বেহেস্তের পথ সুগম করে দেন। রহমতের ফেরেস্তারা ইলম অর্জনকারীকে নিজের পাখা বিছিয়ে দেয়। ‘ইলম’ আরবী শব্দ। এর অর্থ বুঝা, উপলব্ধি করা। পারিভাষিক অর্থ, এটা এমন আলো, যা আল্লাহ তাঁর প্রিয় মানুষের অন্তরে ঢেলে দেন। অতঃপর তিনি তা দ্বারা বস্তুর তত্ত¡ ও রহস্য জানতে পারেন’। মুআবিয়াহ (রাঃ) আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান,তাকেই দ্বীনী জ্ঞান দান করেন।” (বুখারী) । করুণাময় আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (সাঃ)-কে অহি-র জ্ঞান শিক্ষা দেন। সুতরাং আমাদের সমাজ ও দেশ থেকে অন্যায়, অপকর্ম দূর করতে ইলমের গুরুত্ব অপরিসীম। ইলম অর্জনের নির্দেশনা স্বরূপ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলিমের উপরে জ্ঞান অন্বেষণ করা ফরয (ইবনু মাজাহ ) । ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
মানুষ অজ্ঞ-মূর্খ হয়ে পৃথিবীতে আসে। আল্লাহ বলেন. ‘আমি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছি, যা সে জানত না’ (‘আলাক্ব ৯৬/৫)। ইলম বা জ্ঞান দ্বারা ভাল-মন্দ নির্ণয় করা যায়। এর দ্বারা অন্যায়ের প্রতিরোধ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব। সুতরাং আল্লাহ যার মঙ্গল চান এবং যার দ্বারা হক্বের বাস্তবায়ন সম্ভব তাকেই মহামূল্যবান জ্ঞান দান করে থাকেন। যেহেতু জ্ঞানের মালিক আল্লাহ, তাই এই জ্ঞান আল্লাহ যাকে চান তাকে দান করেন। পার্থিব শিক্ষায় শিক্ষিত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার নয় মহান আল্লাহ সম্পর্কে যারা সঠিক ধারণা রাখে এবং তার শারঈ বিধি-বিধান পরিপূর্ণভাবে জানে এবং মেনে চলে তারাই প্রকৃত জ্ঞানী। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ সাক্ষ্য প্রদান করেন যে, নিশ্চয়ই তিনি ব্যতীত কোন সত্য মা‘বুদ নেই এবং ফেরেশতাগণ ও ন্যায়নিষ্ঠ বিদ্বানগণ (সাক্ষ্য প্রদান করেন)। তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্য মা‘বুদ নেই। তিনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’ (আল ইমরান ৩/১৮)। আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি এমন পথে গমন করে;যাতে সে বিদ্যা অর্জনকরে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেন।” (মুসলিম)
ইলম অর্জনের মর্যাদা অত্যধিক। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামবলেছেন: যে লোক জ্ঞানার্জন করার জন্য বের হয় সে ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহররাস্তায় (জিহাদের মাঝে) আছে বলে গণ্য হয় ( তিরমিযী)। যাচাই পূর্বক দ্বীনী এলেম গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রবৃত্তির অনুসরন করা যাবে না। ‘আব্দুল্লাহ ইবনে ‘আমর ইবনে ‘আস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, “নিঃসন্দেহে আল্লাহ লোকদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ইলম তুলে নেবেন না; বরং উলাম াস¤প্রদায়কে তুলে নেওয়ার মাধ্যমে ইলম তুলে নেবেন (অর্থাৎ আলেম দুনিয়া থেকেশেষ হয়ে যাবে।) অবশেষে যখন কোন আলেম বাকি থাকবে না, তখন জনগণ মূর্খ অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরকে নেতা বানিয়ে নেবে এবং তাদেরকে ফতোয়া জিজ্ঞাসা করা হবে, আর তারা না জেনে ফতোয়া দেবে, ফলে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে এবং অপরকেও পথভ্রষ্ট করবে।” (বুখারী ও মুসলিম)। আবু হোরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি এমন কোন জ্ঞান অর্জন করল, যার দ্বারা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, তা সে কেবল পার্থিব স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে অর্জন করল, কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তি জান্নাতের সুগন্ধ পর্যন্ত পাবে না” (আবূ দাউদ)। ইহজগতে প্রয়োজনীয় কিছুই পরকালে কোন কাজে লাগবে না। তাই ইহজগতের দিকে বেশি আসক্ত হওয়া যাবে না। কিন্তু জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। একজন সাহাবী বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, “ইহ জগৎ অভিশপ্ত, এর মধ্যে যা কিছু আছে সব অভিশপ্ত।তবে মহান আল্লাহর যিকির ও তার সংশ্লিষ্ট ক্রিয়া (তাঁর আনুগত্য) এবং আলেম অথবা তালিবে ইলমের কথা স্বতন্ত্র” (তিরমিযী ) । রক্ত সম্পর্ক কিংবা বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে কোন ব্যক্তির ওয়ারিছ হওয়া যায়। কিন্তু ইলম এমন একটি মূল্যবান সম্পদ, যে ব্যক্তি তা অর্জন করবে আল্লাহ তাকে নবীদের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী বানাবেন। সুতরাং আল্লাহ সম্পর্কে সঠিক ধারণাসম্পন্ন ব্যক্তিরা মূলতঃ নবীদের উত্তরাধিকারী। আর উত্তরাধিকার জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। রাসূল (সাঃ) বলেছেন ‘আলেমরাই নবীগণের উত্তরাধিকারী। নবীগণ দীনার বা দিরহামের উত্তরধিকারী করেন না। বরং তারা ইলমের উত্তরাধিকারী করেন। ফলে যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করল সে বৃহদাংশ গ্রহণ করল (ইবনু মাজাহ ) । অতএব দ্বীনি ইলম অর্জন করলে নবীদের উত্তরাধিকারী হওয়া যায়। ইলম অর্জনের প্রধান উৎস কোরান। কোরানের জ্ঞান বাদে কেউ পূর্ণাঙ্গ মুসলমান হতে পারে না। কোরান যেহেতু আরবী ভাষায় নাজিল হয়েছে তাই আমাদেরকে অবশ্যই আরবী শিখতে হবে। হাদিসগুলোই আরবী ভাষায় লিখিত হয়েছে। তাই কোরান- হাদিস জানার জন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কিংবা আলেমদের সাহায্য নেয়া উচিত। তবে বর্তমানে বাংলা ভাষায় কোরানের অনুবাদ , হাদিসের ব্যাখ্যাসহ গুরুত্বপূর্ণ বই পুস্তক রচিত হয়েছে। বাংলা শিক্ষিত যে কোন মুমিন- মুসলমান সহজেই তা অধ্যয়ন করতে পারেন। তবে এ শিক্ষা হতে হবে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য। আল্লাহ বলেন, বলুন আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, ও মৃত্যু জগতসমুহের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য ( আন আম-৬/১৬২)।
দ্বীনী এলেম অর্জন করার জন্য কষ্ট স্বীকার করতে হবে। ইমাম বোখারি (রঃ) তার “ আদাবুল মোফরাদ” নামক বইয়ে লিখেছেন, জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ বর্ণনা করেছেন, আমি এ সংবাদ জানতে পারলাম সিরিয়ায় অবস্থানরত একজন সাহাবী একজন হাদিস বর্ণনা করেন যা তার জানা নেই। পরে ঐ সাহাবী উট কিনে . সমুদয় প্রস্তুতি গ্রহণ করে, একমাস ভ্রমণ করে সেখানে পৌঁছেন। যে সাহাবীর কাছে গেলেন তিনি হচ্ছেন আব্দুল্লাহ ইবনে ওনাইস (রাঃ )। সেখানে পৌঁছে আগন্তুক বল্লেন, একটি হাদিছ সম্পর্কে আমি সংবাদ পেয়েছি যে. আপনি উহা রাসুল (সাঃ) থেকে শুনেছেন, আমার আশংকা হলো এটি শুনার পূর্বে আমার মৃত্যু এসে যায় কি না। তাই এত দূর পথ অতিক্রম করে ছুটে এসেছি। দুঃখজনক হলেও সত্য বর্তমানের মুমিন-মুসলমানদের মধ্যে হাদিস জানার ব্যাপারে এরুপ তৎপরতা লক্ষ করা যায় না। আল্লাহ তা‘আলা সর্বোচ্চ জ্ঞানের অধিকারী। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’ (লুকমান ৩১/২৭)। আর তিনি মানুষকে অতি অল্পই জ্ঞান দান করেছেন। তিনি বলেন ‘তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৮৫)। আল্লাহর জ্ঞান সর্ম্পকে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর জ্ঞানের পরিসীমা সম্পের্কে খিজির (আঃ) মূসা (আঃ)-কে বলেছিলেন ‘হে মূসা! আমার ও তোমার জ্ঞানের স্বল্পতা আল্লাহর জ্ঞানের নিকট সমুদ্রের মধ্যে এই চড়ুইয়ের ঠোঁটের এক ফোটা পানির সমান (বুখারী) । আমরা মুসলমান। মুসলমানের জীবনের প্রতিটি আমল বা কাজের পেছনে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই লক্ষ ও উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। কেননা আল্লাহ একমাত্র তারই ইবাদত করার জন্য আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তাই আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলকে চিনতে হলে এবং প্রদত্ত বিধান সম্পর্কে জানতে হলে ইলম অর্জন করতে হবে। ইমাম বোখারি (রঃ) বলেছেন, মানুষের কথা ও কাজের পূর্বে এলম-জ্ঞান ও শিক্ষা আবশ্যক। মানুষ যে বিষয়ে বলবে , যে কাজ করবে, সে বিষয় প্রথম এলম. জ্ঞান ও শিক্ষা থাকতে হবে। অধ্যয়নলব্দ জ্ঞানই নির্ভরযোগ্য। রাসুল (সাঃ ) যে দ্বীন শিক্ষা দিয়ে গেছেন তা পরবর্তীতে লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা হয়েছে । দ্বীন সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভের জন্য অধ্যয়ন আবশ্যক। একজন মুসলমান যতই মেধাবী হোন না কেন শুধু মাত্র শুনে শুনে ইসলামের সব কিছু শিখতে পারবেন না।
লেখকঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক ও সাংবাদিক, কুমিল্লা।
কালের কন্ঠ ১৯ -০২-১৭
No comments