বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ১৮৩৫ থেকে বর্তমান

 বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা -১৮৩৫ থেকে বর্তমান//মমিনুল ইসলাম মোল্লা , শিক্ষক, সাংবাদিক ও শিক্ষা বিষয়ক বিশ্লেষক, কুমিল্লা।।


বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আজকের যে কাঠামোয় বিদ্যমান, তার ভিত্তি প্রথম স্থাপন করা হয় ১৮৩৫ সালে, ব্রিটিশ শাসনের সময়ে। এই সময় লর্ড ম্যাকলে Macaulay’s Minutes on Education প্রবর্তন করেন, যার মাধ্যমে আধুনিক বা ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি শিক্ষিত ভারতীয় শ্রেণি তৈরি করা, যারা ব্রিটিশ প্রশাসনের জন্য সহায়ক হবে। এই শিক্ষাব্যবস্থা মূলত কেরানি, অনুবাদক, হিসাবরক্ষক ইত্যাদি পদের জন্য দক্ষ কর্মী তৈরির দিকে মনোনিবেশ করেছিল। তাই এর মূল লক্ষ্য ছিল নাগরিক বা সৃজনশীল শিক্ষার বিকাশ নয়, বরং প্রশাসনিক সুবিধা।


১৮৩৫ সালের পর শিক্ষা ব্যবস্থা ধীরে ধীরে তিনটি স্তরে বিভক্ত হতে থাকে। প্রথম স্তর হলো প্রাথমিক শিক্ষা, যা গ্রাম্য এলাকার পাঠশালা বা ছোট স্কুলে প্রদান করা হতো। পাঠ্যসূচিতে ছিল বর্ণমালা, অঙ্ক, ধর্মীয় শিক্ষা এবং নৈতিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ছিল শিশুর মৌলিক জ্ঞান বৃদ্ধি করা। তখন পাঠশালার শিক্ষকরা সাধারণত স্থানীয় সমাজের শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন এবং তাদের বেতন স্বেচ্ছা অনুদান, ধান, পোশাক বা সামান্য নগদ অর্থের মাধ্যমে দেওয়া হতো। এই পর্যায়টি ছিল অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা, যেখানে সরকার বা কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ ছিল না।


দ্বিতীয় স্তর হলো মাধ্যমিক শিক্ষা, যা মূলত হাই স্কুল পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হতো। তখনকার “ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা” আজকের এসএসসি পরীক্ষার পূর্বসূরি। মাধ্যমিক শিক্ষায় ইংরেজি, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল এবং ধর্মীয় জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষাব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক পরীক্ষা ও পাঠ্যক্রম চালু হয়। মাধ্যমিক শিক্ষার সফলতা শিক্ষার্থীদের উচ্চমাধ্যমিক বা কলেজ পর্যায়ে প্রবেশের যোগ্যতা প্রদান করত।


উচ্চমাধ্যমিক স্তর বা HSC (Higher Secondary Certificate)-এর পূর্বে এই স্তরকে বলা হতো F.A. (First Arts) বা ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। এই পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা কলেজে ভর্তি হয়ে সাহিত্য, দর্শন, গণিত, ইতিহাস ও প্রাথমিক বিজ্ঞান অধ্যয়ন করত। HSC পর্যায় শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি দিত।


বর্তমান বাংলাদেশে প্রাথমিক থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থা ১৭টি শ্রেণি বা শিক্ষাবর্ষে বিভক্ত। প্রাথমিক ৫ বছর, মাধ্যমিক ৫ বছর, উচ্চমাধ্যমিক ২ বছর এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে মোট ১৭ বছর। এই কাঠামো আজকের সরকারি শিক্ষা বোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত।


সারসংক্ষেপে, ১৮৩৫ সালে প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা যদিও সীমিত উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল, কিন্তু তা বাংলাদেশে আধুনিক শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করে। এটি ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়, যা আজকের বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের জন্য মৌলিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার ধারাবাহিক পথ তৈরি করেছে।

লেখক পরিচিতি -মমিনুল ইসলাম মোল্লা , শিক্ষক, সাংবাদিক ও শিক্ষা বিষয়ক বিশ্লেষক, কুমিল্লা।।

No comments

Theme images by mammuth. Powered by Blogger.