কুমিল্লা বিমানবন্দরের পুনরুজ্জীবন সময়ের দাবি

 কুমিল্লা বিমানবন্দরের পুনরুজ্জীবন সময়ের দাবি


মমিনুল ইসলাম মোল্লা

সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ঐতিহ্য বিষয়ক লেখক, কুমিল্লা।


কুমিল্লা বিমানবন্দরটি আজও অতীতের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে নিস্তব্ধ পড়ে আছে। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এখানে কোনো ফ্লাইট ওঠানামা করে না। অথচ বিমানবন্দরের অবকাঠামো, ভবন, নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার, নেভিগেশন সুবিধা, ফায়ার স্টেশন, প্রশাসনিক কক্ষসহ প্রায় সবকিছুই এখনও বিদ্যমান। মূল ফটক থেকে রানওয়ে পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় এখন চাষাবাদ ও সামান্য সেনা কার্যক্রম দেখা যায়। বিমানবন্দরের আয়তন প্রায় ৭৭ একর হলেও অব্যবহৃত থাকার কারণে রানওয়ের পিসিএন (Pavement Classification Number) নষ্ট হয়ে গেছে, ভেঙে পড়েছে ঢালাই ব্লক ও পিচ। তবুও এর অস্তিত্ব ও সম্ভাবনা এখনও অটুট রয়েছে।


বৃটিশ আমলে ১৯৪১-৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কুমিল্লা শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে এ বিমানবন্দরটি নির্মাণ করা হয়। তখন এটি ছিল একটি কৌশলগত সামরিক ঘাঁটি, যেখান থেকে যুদ্ধবিমান উঠানামা করত। পরবর্তীতে পাকিস্তান আমল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল চলমান ছিল। সর্বশেষ ১৯৯৪ সালে আবারও স্বল্প সময়ের জন্য বিমান ফ্লাইট চালু হলেও যাত্রী সংকটের কারণে কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। তারপর থেকে আজ অবধি এখানে কোনো ফ্লাইট ওঠানামা করেনি।


তবে ফ্লাইট বন্ধ থাকলেও বিমানবন্দরটি পুরোপুরি অচল নয়। প্রতিদিন এখানকার সিগন্যাল ব্যবহার করছে দেশি-বিদেশি অন্তত ৪০টি বিমান, যা থেকে মাসে ২৫-৩০ লাখ টাকার রাজস্ব আয় হচ্ছে সরকারের। আন্তর্জাতিক রুটে বিশেষত ভারত, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের বিমানগুলো নিয়মিত এই সিগন্যাল ব্যবহার করে। বর্তমানে এখানে ২৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত আছেন, যারা বিমানবন্দরের মূল কাঠামো ও যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্ব পালন করছেন।


বিমান বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিমানবন্দর পুনরায় সচল করতে বড় ধরনের অর্থ বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। প্রায় ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার মধ্যে রানওয়ে সংস্কার, ফায়ার সার্ভিস ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল বিভাগে কিছু অতিরিক্ত জনবল নিয়োগের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ রুটে ছোট আকারের বিমান চলাচল চালু করা সম্ভব। প্রয়োজনে ভবিষ্যতে কলকাতা, আগরতলা বা আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক রুটেও সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।


কুমিল্লার বর্তমান প্রেক্ষাপট আগের তুলনায় অনেক ভিন্ন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বিস্তৃত হয়েছে শতাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ইপিজেড ও বিসিক শিল্পনগরী। প্রতিনিয়ত বিদেশি ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও কর্মকর্তাদের যাতায়াত বাড়ছে। বিমান যোগাযোগের সুযোগ থাকলে এই শিল্পাঞ্চল আরও গতিশীল হবে, বিদেশি বিনিয়োগও বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, নোয়াখালী ও ফেনী জেলার জনগণও এ সুবিধার আওতায় আসবে।


সচেতন নাগরিক সমাজের মতে, বিমানবন্দরটি পুনরায় চালু হলে কুমিল্লার ঐতিহ্য, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। সময় ও দূরত্বের বাধা কমে যাবে, উন্নয়নের গতি আরও ত্বরান্বিত হবে। বর্তমানে সরকারের নিকট থেকে সামান্য উদ্যোগ ও অর্থ বরাদ্দ পেলেই এই বিমানবন্দরটি আবারও প্রাণ ফিরে পেতে পারে।


কুমিল্লা একটি ঐতিহ্যবাহী ও প্রগতিশীল জেলা। এখানে প্রশাসনিক, শিল্প ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঘনত্ব অনেক। তাই দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা বিমানবন্দরের কার্যক্রম পুনরায় চালু করা শুধু স্থানীয় নয়, জাতীয় উন্নয়ন কাঠামোর সাথেও প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। এখন প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দ্রুত বাস্তবায়ন উদ্যোগ।


কুমিল্লা বিমানবন্দরের পুনরুজ্জীবন আজ কুমিল্লাবাসীর একান্ত প্রত্যাশা—এটি সময়েরই দাবি।

লেখক পরিচিতি -মমিনুল মমিনুল ইসলাম মোল্লা, কলামিস্ট ও ঐতিহ্য বিষয়ক লেখক, কুমিল্লা।


No comments

Theme images by mammuth. Powered by Blogger.