বেসরকারি শিক্ষকগণ দায় না সম্পদ
বেসরকারি শিক্ষকগণ দায় না সম্পদ
২০১১ সালের দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত
মমিনুল ইসলাম মোল্লা, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও শিক্ষক, কুমিল্লা।।
চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ২৩ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। গত ৯ জানুয়ারি থেকে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এবং কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি পালন করছেন। এর আগে ২২ জানুয়ারি সরকার চিকিৎসা ভাতা ও বাড়িভাড়া বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ মঙ্গলবার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ভাতা বৃদ্ধির এ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, "শিক্ষকরা আগে যে ভাতা পেতেন, তা খুবই অপ্রতুল। বিগত ১৮ বছর ধরে তারা এভাবেই চলছিলেন। এই টাকা যথেষ্ট বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল।"
১৯৮৪ সালে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া ১০০ টাকা এবং চিকিৎসা ভাতা ৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে চিকিৎসা ভাতা দুই দফা বাড়িয়ে ১৫০ টাকা করা হলেও বাড়িভাড়া আগের মতোই থাকে। অন্যদিকে বর্তমান বেতন কাঠামো অনুযায়ী সরকারি স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীরা মূল বেতনের ৪৫ শতাংশ হারে (সর্বনিম্ন ৪ হাজার টাকার মতো) বাড়িভাড়া এবং ৪৫০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। মাসে ৫০০ টাকায় বর্তমান বাসাভাড়া পাওয়া অসম্ভব হলেও ভাতা বৃদ্ধির ফলে শিক্ষকরা “খুশি হবেন” বলে আশা প্রকাশ করেন মন্ত্রী।
এদিকে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া ৫০০ টাকা ও চিকিৎসা ভাতা ৩০০ টাকা অযৌক্তিক দাবি করে শিক্ষক সংগঠনগুলো শিক্ষামন্ত্রীর এ ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের অপর অংশের চেয়ারপারসন অধ্যক্ষ নূর আফরোজ বেগম জাতির সভাপতিত্বে জরুরি সভায় শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করে ৩০ জানুয়ারির মধ্যে চাকরি জাতীয়করণের ঘোষণা না এলে আমরণ অনশনসহ কঠোর কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ৯৫ শতাংশই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। অথচ বেসরকারি শিক্ষকগণ বর্তমানে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত, নিগৃহীত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত। মাস্টার্স ডিগ্রি পাস করা একজন শিক্ষক অজপাড়াগাঁয়ে গিয়ে শ্রম দিয়ে কী পাচ্ছেন?
অথচ একই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কেউ ক্যাডার সার্ভিসে (প্রশাসন) যোগ দিয়ে পদোন্নতির মাধ্যমে সচিব পর্যায় পর্যন্ত যেতে পারেন। অন্যদিকে বেসরকারি কলেজের শিক্ষকগণ পুরো চাকরি জীবনে একটি মাত্র পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অধ্যাপক হতে পারেন, সেটিও এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তাই বেসরকারি শিক্ষকগণ নিজেদেরকে দেশের বোঝা হিসেবেই ভাবছেন।
সরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার চেয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারের নজরদারি অনেক বেশি বলে অনেকেই মনে করেন। শুধুমাত্র ৫ পয়েন্ট হলেও সরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার যোগ্য বলে বিবেচিত হন, কিন্তু বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় চাকরির জন্য নির্ধারণ করা হয় ৭ পয়েন্ট—যা একটি মারাত্মক বৈষম্য।
এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা, ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষক নিয়োগ এবং পরীক্ষার ফলাফল বিবেচনা করা হয়। কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ শিক্ষার্থী পাশ না করলে ঐ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক অনুদান বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বেতন-ভাতার সরকারি অংশ পাওয়ার জন্য ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখে একটি পরিপত্র জারি করা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়—উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের ১১শ ও ১২শ শ্রেণিতে শহরে ২০০ জন এবং মফস্বলে ১৫০ জন বালিকা ও ১২০ জন ছাত্র-ছাত্রী থাকতে হবে। এছাড়া ডিগ্রি কলেজগুলোতে কমপক্ষে ৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী স্নাতক পর্যায়ে থাকতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সাধারণত প্রতি বিভাগে ৪টি বিষয় থাকবে। তবে ৫ম বা ততোধিক বিষয় খুলতে হলে ঐ বিষয়ে অন্তত ২৫ জন শিক্ষার্থীসহ মোট ৫০ জন থাকতে হবে।
পরীক্ষায় পাশের হারের উপর ভিত্তি করে এমপিও বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় শহরে ৫০ জন পরীক্ষা দিলে অন্তত ২৫ জনকে পাশ করতে হবে এবং মফস্বলে ৩০ জন পরীক্ষা দিলে অন্তত ১৫ জনকে পাশ করতে হবে।
সরকারি নীতিমালা স্পষ্ট না থাকায় বেসরকারি শিক্ষকরা বহু দুর্দশা ভোগ করছেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বেসরকারি শিক্ষকগণ এখনকার তুলনায় খুব কম বেতন পেতেন। একটি পরিসংখ্যান দেখা যায়—১/১/৮১ ইং থেকে বেসরকারি শিক্ষকগণ সরকারি সমমানের বেতনক্রম পেতে শুরু করেন। ১/১/৮০ থেকে ৩০/০৬/৮২ ইং পর্যন্ত কেবলমাত্র প্রারম্ভিক স্তরের ৫০% প্রদান করা হয়। ১/১/৮৪ থেকে ২৮/০২/৮৬ ইং পর্যন্ত চিকিৎসা ভাতা ও বাড়িভাড়া ১০০ টাকা এবং বার্ষিক বর্ধনসহ সুবিধাদি যুক্ত হয়। ১/৭/৮৬ থেকে ৩০/৬/৮৯ ইং পর্যন্ত সময় ৭০% বেতনের অংশ প্রদান করা হয়। ১/১/৯৫ থেকে সরকারি বেতনের অংশ ৮০%, ১/৭/০০ ইং থেকে ৯০% এবং ২০০৬ সালে ১০০% বেতন প্রদানের ঘোষণা দেওয়া হয়। বর্তমানে শিক্ষকগণ মূল বেতনের ১০০% পেলেও বাড়িভাড়া মাত্র ১০০ টাকা এবং চিকিৎসা ভাতা ২৫০ টাকা পান। এর থেকেও কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধার জন্য ৮% কেটে রাখা হয়।
শিক্ষকগণ অন্যান্য পেশাজীবী সম্প্রদায়ের মত নন। তারা অল্পতেই সন্তুষ্ট। তারপরও যখন দেখেন পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে, তখনই আদালত মুখী হন। মূলত জিয়াউর রহমানের শাসনামল থেকেই শিক্ষকগণ আদালতের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হন। এরপর প্রতিটি সরকারের আমলেই তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে আদালতে যেতে হয়েছে। মিছিল, মিটিং, বিক্ষোভ, সমাবেশ, ধর্মঘট, অনশন—কোনটাই তারা বাদ দেননি। আদালতে যেতে গিয়ে শিক্ষকের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
তাই বর্তমান প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে তাদের বঞ্চিত করলে তারা পিছিয়ে যাবেন—এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। শিক্ষাগত যোগ্যতা একই হওয়ার পরও সরকারি শিক্ষকদের সাথে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধায় ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
সরকারি শিক্ষকগণ পান: পূর্ণ জাতীয় বেতন স্কেল, প্রতি বছর ইনক্রিমেন্ট, মূল বেতনের সমান দুটি উৎসব ভাতা, ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, স্কুলের ৪০–৫৫% বাড়ি ভাড়া, পূর্ণাঙ্গ পেনশন ও পিএফ, চাকরির নিরাপত্তা, সন্তানদের পড়াশোনায় সরকারি সহায়তা।
বেসরকারি শিক্ষকগণ এগুলোর অধিকাংশ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
বাংলাদেশে বর্তমানে কয়েকটি শিক্ষক সংগঠন রয়েছে—বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি, আদর্শ শিক্ষক পরিষদ, বাংলাদেশ স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ, মাদ্রাসা শিক্ষক পরিষদ, জমিয়তে মুদাররিছিন, শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট, জাতীয় শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ইত্যাদি।
শিক্ষকগণ রাজনীতির বাইরে নন। সরকার-সমর্থিত সংগঠনগুলো সবসময় আন্দোলনে নিরব ভূমিকা পালন করে, আর বিরোধীদল-সমর্থিত সংগঠনগুলো দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে সবসময় সক্রিয় থাকে। বিরোধীদলীয় নেতারাও এ ব্যাপারে সচেতন। শিক্ষকগণ অনশন করলে তারা অনশন ভাঙানোর জন্য শরবতের গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন, কিন্তু ক্ষমতায় গেলে শিক্ষকদের কথা ভুলে যান।
মনে রাখতে হবে—শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়, তাহলে শিক্ষকগণ হলেন শিক্ষার মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড সোজা না থাকলে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে না।
রাজধানীতে বুধবার সকাল থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট’-এর ব্যানারে শিক্ষক-কর্মচারীরা অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। সংগঠনটি চাকরি জাতীয়করণের ঘোষণা না আসা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ ঘোষণা শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক এবং সহনীয় নয়।
শিক্ষাব্যবস্থা সরকারিকরণের দাবিসহ ১৭ দফা দাবিতে শিক্ষকদের ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে। শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ সলিম ভূঁইয়া জানান, বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধির ঘোষণার মাধ্যমে শিক্ষকদের অপমান করা হয়েছে। চাকরি জাতীয়করণের ঘোষণা না আসা পর্যন্ত শিক্ষকরা বাড়ি ফিরবেন না। প্রধানমন্ত্রী যদি শিক্ষকদের জাতীয়করণের ঘোষণা দেন, তবে সঙ্গে সঙ্গেই তারা বাড়ি ফিরবেন।
No comments