মুরাদনগরের চাপিতলা শহিদদের ভুলিনি,ভুলবনা

 

মুরাদনগরের চাপিতলা শহিদদের ভুলিনি,ভুলবনা মমিনুল ইসলাম মোল্লা


মুরাদনগরের চাপিতলা শহিদদের ভুলিনি,ভুলবনা
মমিনুল ইসলাম মোল্লা,সাংবাদিক,কলামিস্ট,কুমিল্লা।।

১৯৭১ সালে মুরাদনগরের বহু যায়গায় সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু এ স্মৃতি অঅজ সবাই ভূলে যাচোছ। প্রশাসনের উদ্যোগে বাখরাবাদ, কােম্পানীগঞ্জ , দরানীপাড়ায় গড়ে উঠেনি কোন স্মৃতি স্তম্ভ। তেমনি এটি বিদনাবিদুর স্থান মুরাদনগর উপজেলার চাপিতলা। ামেনকি ঘঁনার দিনটি নিয়েও ধোয়াশা দূও হয়নি। কেউ কেউ বলছেন ঘঁনা ঘটেছে ৩১ অক্টোবর। কিন্তু স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদেও মতে সেই ভয়াভহ দিনটি ছিল ৭ নভেম্বও রবিবার। 
যুদ্ধের ঘটনাঃ যুদ্ধ শুরু হয় ৭ নভে¤বর রবিবার। যুদ্ধের বা আক্রমণের আশংকা  থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা হাতিয়ার নিয়ে তৈরি থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতিয়ারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, জেলেটিন, এক্সপ্লোসিভ, গোলা বারুদ, এনারগা-৯৪ রাইফেল,  ৩৬ হ্যান্ড গ্রেনেড, এসএমজি, এসএমসি, এ্লএমজি এন্টিপারসোনাল মাইন, এন্টি ট্যাংক মাইন, ২ ইঞ্চি মর্টার ইত্যাদি। 

প্রথম প্রতিরোধঃ একটি ছেলে দৌড়ে এসে কমান্ডার কামরুল হাসান ভুইয়াকে খবর দিলে শত্রæরা রঘুরামপুরের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে হানা দিয়েছে। সেখান থেকে দ্রæত পূর্বদিকে এগিয়ে আসছে। শীতকাল হওয়ায় তখন জমিতে সামান্য পানি ছিল। পাকিস্তানি সৈনিকেরা ধানী জমির মধ্য দিয়ে দ্রæত বেগে হেঁটে রওয়ানা দেয়। শত্রæকে বাধা দেয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রবর্তী দল চাপিতলা নিমাইঝুড়ি খালের উপর অবস্থিত বর্তমান চাপিতলা বাস স্টেশন ব্রিজের পাশে প্রতিরক্ষা বুহ্য গড়ে তোলে। মুক্তিযোদ্ধারা আগে থেকেই ব্রিজের দুই পাশের মাটি কেটে খালের মধ্যে ফেলে দেয়। এছাড়া চাপিতলা গ্রামের দক্ষিণাংশে রুক্কু শাহ এর মাজারের পাশে অবস্তিত গাঙ্গেঝুড়ি ব্রিজ , বাস স্টেশন ব্রিজ ও খাপুড়া ব্রিজসহ টনকী থেকে খামারগাঁও মাদ্রাসা পর্যন্ত যতগুলো  ব্রিজ রয়েছে সবগুলোতে মাইন পোতা হয়েছিল। আর এ কাজটি স্বল্পপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সহজ কাজ ছিল না। এ কাজে কেউ সহজে যেতে চাইত না। এগুলো ছিল বুবি টেপ লাগানো মাইন। এগুলো সাধারণভাবে মাইন বা বিস্ফোরক হিসেবে প্রতীয়মান হয় না। কিন্তু যখনই এতে চাপ পড়ে বা টান পড়ে বা ঢিল দেয়া হয় তখনই তা বিস্ফোরিত হয়। মাইন লাগানোর গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে গনি নামের এক সাহসী মুক্তিযোদ্ধা , এম-১৪ এন্টি পারসোনাল মাইন গণি একাই ১৮টি নির্ধারিত স্থানে ফিট করে খুঁটি পুঁতে তাতে তা আটকে রাখে। বিষ্ঞুপুর গ্রামের ভেতর দিয়ে আসা পাকিস্তানি সৈনিকদের দলটিকে আটকানোর জন্য মুক্তিযোদ্ধারা কমান্ডার কামরুল হাসান ভূইয়ার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয়। কমান্ডোরের পাশে ছিল হাবিলদার রমিজের প্লাটুন। শত্রæরা এফইউপি ছেড়ে এসাল্ট ফরমেশনে প্রচন্ড ফায়ার করতে করতে এগিয়ে আসে। কমান্ডার চিৎকার করে প্লাটুন কমান্ডার ইপিআরের হাবিলদারকে বার বার ফায়ার করতে বলেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তিনি তা করলেন না। পরিস্থিতি খারাপ দেখে কমান্ডার তখন সবইকে দ্রæত পেছনে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এসময় পাকিস্তানী সৈনিকেরা চাপিতলা গ্রামের ৩৪ জন নারী- পুরুষকে  নির্বিচারে হত্যা করে , ২১ জন নারীর শ্লীলতাহানী করে এবং ৩০টি বাড়ির দেড় শতাধিক ঘর জ্বালিয়ে দেয়। 

দ্বিতীয় পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা বাংঙ্গরা, খাপুড়া ও খামারগাঁও এলাকায় অবস্থান নেন। সেদিন জোৎস্না রাত থাকলেও এলাকা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় এবং গ্রামের রাস্তাঘাট না চেনার কারণে সৈনিকরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে আঁচ করতে পারে নি। এছাড়া শত্রæর সম্ভাব্য আগমন পথে মাইন দ্বারা বুবি ট্যাপ লাগানোর কারণে শত্রæরা সুবিধে করতে পারে নি। 
মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অবস্থান থেকে ৮০ স্মোক গ্রেনেড ফাটিয়ে ধুম্রজালের সৃষ্টি করে। এসময় তারা নিরাপদ অবস্থানে চলে যায়। রাত ৩ টার দিকে সৈনিকদের অগ্রবর্তী দলটি মুক্তিযোদ্ধাদের  খুজতে খুঁজতে ব্যাংকারের নিকট চলে আসে। প্রতিরক্ষার সুবিধার্থে কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর রোডের পূর্ব পার্শ্বে  খামারগাঁও মাদ্রাসা ও পশ্চিম পাশে কবস্থানের নিকট ট্রান্স ( গর্ত) করেছিল। শত্রæ এফইউপি ছেড়ে ২০০ গজের মত দূরে এসছিল। কিন্তু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড গুলির আঘাতে টিকতে না পেরে ধান ক্ষেতের দিকে পালিয়ে যায়। নিহত ও আহতদের ফেলে তারা চাপিতলা অজিফা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়ে অবস্থিত তাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে ফিরে আসে। এসময় নৌকাযোগে আহত ও নিহতদের লাশগুলো সিএন্ডবি ব্রিজের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে গাড়ি দিয়ে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। 
চুড়ান্ত আক্রমণঃ তৃতীয় বা চুড়ান্ত আক্রমণ করা হয়  পরদিন  সোমবার সকাল ৯টায়। খামারগাঁও গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা যেখানে আশ্রয় নিয়েছিল তার পশ্চিম দিক থেকে শত্রæ আক্রমন করে। মুক্তিযোদ্ধারা পূর্ণভাবে প্রস্তুত ও সতর্ক অবস্থানে থাকায় শত্রæরা সুবিধা করতে পারেনি। এখানে দুপক্ষের মধ্যে প্রচন্ড গুলি বিনিময় হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশ ছিলস্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত , তারা গুলির নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি। ফলে প্রচুর পরিমান অস্ত্র ও গোলাবারুদ ক্ষয় হয়। তা না হলে দিনের বেলা পরিচালিত এ যুদ্ধে রাতের যুদ্ধের মতই সাফল্য আসতো। গোলা বারুদ নতুন করে সংগ্রহ করতে হলে ভারতের মেলাঘরে যেতে হবে। স্বল্প সময়ে তা সম্ভব ছিল না। ফলে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটার নির্দেশ দেন। 
গোলা-বারুদের ঘাটতি বাদেও পিছু হটার আরেকটি কারণ ছিল। সেটি হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্লান্তি। দীর্ঘ সময় ধরে  যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা যুবক ছেলেদের ছিলনা রোববার দিনে ও রাতে যুদ্ধ করে অনেকেই আহত ও ক্লান্ত ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বেশিরভাগ ছিল ভারতীয় ৭-৬২ মি.মি বোল্ট একশন রাইফেল। এ রাইফেল দিয়ে ফায়ার করে দুদিনেই ছেলেদের হাতে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল। খামারগাাঁও থেকে পিছিযে আসার আগেই বিকল্প প্রতিরক্ষা তৈরি করা হয়েছিল দৌলতপুরে। এটি মোটামুটিভাবে মজবুত প্রতিরক্ষা ছিল। এখানে একটি এলএমজি সহ ৭জনের একটি সশস্ত্র দল প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে সমস্ত প্রতিরক্ষা গুটিয়ে বাঙ্গরার ( নবীনগর থানা) দিকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। 
কিন্তু এ অবস্থায়ও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন সাহসী যোদ্ধা হাবিলদার রমিজ উদ্দিন। কিন্তু এক সময় রমিজ উদ্দিনের গুলি ফুরিয়ে যায়। রমিজ উদ্দিনের পাশে ছিল আবুল বাশার ( বলিঘর) , বাচ্চু মিয়া ( দেলবাড়ি) । রমিজ উদ্দিন তার এক সহযোদ্ধার মাধ্যমে কমান্ডারের কাছে আরো গোলা-বারুদ চায়। এমুনিশন থেকে প্রায় ৪০০ রাউন্ড এমুনিশন পাঠানো হয়। আবারো খবর পাঠানো হয় রমিজ উদ্দিনের প্লাটুন অপসারন করতে। কিন্তু রমিজ তাতে কান না দিয়ে প্রাণপনে যুদ্ধ করতে থাকে। গুলি করতে করতে তারা ট্র্যান্সের উপর উঠে গিয়ে কবরস্থানের এক পাশে অবস্থান নেন। কিন্তু শত্রæুর সংঘবদ্ধ আক্রমনের মুখে একসময় তিন জনকেই শাহাদাত বরণ করতে হয়। দেশের জন্য শহীদ হলেন রমিজ বাহিনী। দেশপ্রেমিকতার  পরিচয় দিতে গিয়ে রমিজের গায়ে ৩৬টি গুলি লাগে। পাকিস্তানী সৈনিকগণ খামারগাঁও  গ্রামে প্রবশ করে কয়েকজনকে হত্যা করে এবং ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।  তারপর পাকিস্তানি সৈনিকগণ তান্ডব সৃষ্টি করতে করতে কাশিমপুরের পীর সাহেব ( গফুর চিশতি) বাড়ি পর্যন্ত  যাওয়ার সময় দৌলতপুরের ৩জনকে হত্যা করে।  তারপর আর সামনের দিকে এগুইনি। তারা পেছন ফিরে চলে আসে কোম্পানীগঞ্জ। তারপর ময়নামতি সেনানিবাসে ফিরে যায়। 
যে সব এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা অংশ নেয় ঃ চাপিতলা -খামারগাঁও যুদ্ধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের পাশাপাশি এলাকাবাসী স্বতস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধারা আসেন ভারতের মেলাঘর ক্যাম্প থেকে। সেখান থেকে কমান্ডার কামরুল হাসান ভূইয়া ( পরবর্তীতে মেজর) ২১ বছরের অভিজ্ঞ হাবিলদার রমিজ উদ্দিন, হাবিলদার কুদ্দুস, নায়েক নুরুল হকসহ একটি সুসজ্জিত বাহিনী যুদ্ধের ২দিন আগে চাপিতলার অদূরবর্তী কাশিমপুর গ্রামে পৌঁছলে এলাকাবাসী তাদের সহযোগীতায় এগিয়ে আসে। এলাকাবাসীর মধ্যে অহিদ কেরানী এককভাবে পাকিস্তানী সৈনিকদের পর্যুদস্ত করার চেষ্টা করে। পাকিস্তানী সৈনিকেরা সম্মুখ যুদ্ধ বাদেও বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান করে এবং নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। এসময় অহিদ কেরানী রাইফেল দিয়ে গুলি করে ৬ জন সেনিককে হত্যা করে এবং পরবর্তীতে স্ত্রীপুত্র সহ সৈনিকদের হাতে শহীদ হয়। এসময় পাকিস্তানী সৈনিকগণ চাপিতলার ৩৪ জন , খামারগ্রামের ৬জন এবং  দৌলতপুরের ৩ জনকে হত্যা করে । চাপিতলার যুদ্ধ ছিল একটি পরিকল্পিত যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধারা গোপনসূত্রে খবর পেয়ে মুরাদনগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে চাপিতলায় এর জমায়েত হয়। বিশেষ করে চাপিতলা , পু®কুনীরপাড় , খাপুরা , খামারগাাঁও , বাঙ্গরা ,দৌলতপুর , শ্রীরামপুর ও টনকী গ্রামের সাধারণ লোকজন ও মুক্তিযোদ্ধারা  এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সরাসরি যুদ্ধে যারা  শহীদ হনঃ ১.  রমিজ উদ্দিন পিতা-মোছলেহ উদ্দিন (ইপিআর এ কর্মরত ছিল) পুষ্কুনীরপাড় , মুরাদনগর,কুমিল্লা ২. আবুল বাশার পিতা-মৃত পরচান মিয়া, ( ছাত্র) বলিঘর,মুরাদনগর, কুমিল্লা। এ দুজনের কবর সংরক্ষিত অবস্থায় খামারগাঁও  (কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর রোডের পাশে)রাস্তার পাশে অবস্থিত। ৩. বাচ্চু মিঞা পিতা- মৃত চেরাগ আলী , দেলবাড়ি,মুরাদনগর, কুমিল্লা। 

যুদ্ধের ফলাফলঃ মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী সৈনিকদের সফলভাবে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হলেও একসময় তারা পশ্চাদপসারন করতে বাধ্য হন। ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধরত অবস্থায় মারা যান। উত্তেজিত সৈনিকেরা চাপিতলা গ্রামের ৩৪জন নারী পুরষকে নির্বচারে হত্যা করে। এছাড়া ৩০টি বাড়ির প্রায় দেড় শতাধিক ঘর-বাড়ি পাকিস্তানী সৈনিকগণ আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরক্ষা বেস্টনি উঠিয়ে মালাই বাঙ্গরা চলে যায়। পকিস্তানী সৈনিকদের ২ জন অফিসারসহ ৫৫ জন সৈনিক মারা যায়। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী সেদিনের যুদ্ধে ৯৭ জন আর্মি এবং ৯জন রাজাকার মিলে মোট ১০৬ জন মারা যায়। পাকিস্তানী সৈনিকেরা পীরকাশিমপুরের পীর সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করে ময়নামতি সেনানিবাসে ফিরে গেলে চাপিতলা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। 

মমিনুল ইসলাম মোল্লা, প্রভাষক, সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, কুমিল্লা

No comments

Theme images by mammuth. Powered by Blogger.