বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দেশি-বিদেশি সংবাদপত্রের ভূমিকা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দেশি-বিদেশি সংবাদপত্রের ভূমিকা
মমিনুল ইসলাম মোল্লা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দেশি-বিদেশি সংবাদপত্রের ভূমিকা
মমিনুল ইসলাম মোল্লা,সাংবাদিক,কলামিস্ট,কুমিল্লা।।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে গনমাধ্যম। বিশেষত প্রিন্ট মিডিয়া তখন পাশে ছিল। এছাড়া বিদেশী সাংবাদিকগণ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যুদ্ধের লেলিহান শিখা ও কাহিনী ছড়িয়ে দেয়, ফলে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অপপ্রচারে কেউ বিশ্বাস করেনি। দেশীয় সংবাদপত্রগুলো পাক বাহিনীর রোষানলে পতিত হলেও হাতে লিখে পত্রিকা বের করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যচিত্র তুলে ধরে দেশবাসীকে উজ্জিবীত করে। ২৫ মার্চে গনহত্যার চিত্র যাতে বিশ্ববাসী জানতে না পারে সেজন্য পাক বাহিনী বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং এর জন্য তাদের পরিকল্পনা সাফল্য লাভ করেনি। তিনিই সর্ব প্রথম বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেন পাকিস্তানে গনহত্যা হয়েছে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সরকার সকল বিদেশী সাংবাদিককে কৌশলে হোটেল শেরাটনে (বর্তমান রুপসী বাংলা হোটেল) আটক কওে ফেলে। পরদিন তাদেরকে উড়োজাহাজে করে তাদের দেশে পাঠিয়ে দেয়। ফলে বিদেশী সাংবাদিক শূণ্য হয়ে পড়ে ঢাকা। এরই মধ্যে একজন পালিয়ে থাকতে সক্ষম হন। তার নাম সাইমন ড্রিং। সামরিক শাসকের নির্দেশ অমান্য করে তিনি লুকিয়েছিলেন হোটেলে। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ উঠে গেলে হোটেলের কর্মচারীদের সহযোগীতায়এক এক ঘুওে দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক, ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। এসব স্থানে শুধু লাশ আর লাশ পড়ে থাকতে দেখেন। এসব দেখে তিনি লন্ডনের ডেইলী টেলিগ্রাফ পত্রিকায় লিখেন- “ ট্যাংকস ক্রাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান”এ সংবাদ ৩০ মার্চ ছাপা হওয়ার পর বিশ্ববাসী জানতে পারে পাকিস্তানে কী হচ্ছে।
এর আগে পাকিস্তান সরকার রেডিও -টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছিল ঃ ভারতীয় কিছু অনুচর পূর্ব পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করে নাশকতামূলক তৎপরতা চালাচ্ছে। সাইমন ড্রিং এর সংবাদের মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে পারল বাঙ্গালীদের উপর নির্যাতন চলছে। ৭১ সালের প্রথম দিকে পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্রে আওয়ামীলীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, শেখ মুজিবকে ইয়াহিয়া কর্তৃক পাস্তিানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী সম্বোধনও ভূট্টোর অগণতআন্ত্রিক দাবী নিয়ে সংবাদ ও সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। এতে শাসকগোষ্ঠীর ও পিপিপি”র আসল চেহারা উন্মোচিত হলে সরকার প্রেস সেন্সরশীপ এবং প্রেস এডভাইজ আরোপ করে।মুক্তিযুদ্ধের সময় উল্লেখযোগ্য পত্রিকা ছিল- দৈনিক জয় বাংলা, ও দৈনিক বাংলাদেশ। সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকার মধ্যে ছিল -দেশ বাংলা, দুর্জয় বাংলা, শ্বাশ্বত বাংলা, সংগ্রামী বাংলা, মুক্ত বাংলা, নতুন বাংলা, স্বাধীন বাংলা, জাগ্রত বাংলা, সোনার বাংলা, সাপ্তাহিক বাংলা, বিপ্লবী বাংলাদেশ, এছাড়া আরো ছিল প্রতিনিধি, স্বদেশ, বঙ্গবাণী, বাংলার মুখ, স্বরাজ, হাতিয়ার, অভিযান, একতা, দাবানল, অগ্রদূত, রনাঙ্গণ। আমার দেশ, জন্মভূমি, বাংলার বাণী, বিপ্লবী, আন্দোলন, রাষ্ট্রদূত, সপ্তাহ, দি পিপল, দি নেশন, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, কালান্তর, মায়ের ডাক। তৎকালীন সময়ে প্রকাশিত একটি পত্রিকার সম্পাদক জানান, তখন পত্রিকা বের করা খুব কঠিন ছিল। বিশেষ করে পাক হানাদারদেও নজরে আসলে সর্বনাশ হতো। তাই লুকিয়ে লুকিয়ে পত্রিকা বের করতে হতো। তখন সাপ্তাহিক পত্রিকার পাশাপাশি কিছু পাক্ষিক পত্রিকাও বের হতো। এগুলোর মধ্যে অক্ষৌহোনী, চাবুক, স্বদেশ, প্রভৃতি ছিল উল্লেখযোগ্য। এছাড়া আমোদ ( কুমিল্লা) রুদ্রবীণা, ও দর্পন বেশ জনপ্রিয় ছিল। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কুড়িগ্রাম থেকে প্রকাশিত হতো “অগ্রদূত” নামে একটি পত্রিকা। এর সম্পাদক ছিলেন আজিজুল হক মাস্টার। জেনারেল এমএ জি ওসমানী ২ নভেম্বর এ পত্রিকার সম্পাদককে একটি প্রশংসাপত্র পাঠিয়ে অভিনন্দন জানান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর বাংলাদেশের মুজিবনগর থেকে সর্ব প্রথম দৈনিক জয়বাংলা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এটি ছিল মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত প্রথম দৈনিক। ৭১ এর ৩০ মার্চ প্রকাশনা শুরু করেএবং ১১ এপ্রিল এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। “নতুন বাংলা” নামে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির একটি সাপ্তাহিক মুখপাত্র ছিল। এটি ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের তত্বাবধানে প্রকাশিত হতো। মুজিবনগর থেকে এটি ১৯ সংখ্যা পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। ১৯ জুলাই এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। যুদ্ধকালীন সময়ে বন্ধ হয়ে গেলেও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এটি নিয়মিত প্রকাশিত হতো। এ পত্রিকায় স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্যের অনূকূলে মুজিবনগর সরকারের পরামর্শদাতাদের কমিটির কার্যক্রমের উপর গুরুত্ব দেয়া হতো।
আমাদেও মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে ত্রিপুরার পত্রিকাগুলোর বিশেষ অবদান রয়েছে। বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর করূণ অবস্থা তাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। তাই তারা ত্রাণ শিবিরে , গভীরঅরণ্যে, কিংবা অনিশ্চিত আর্শ্যয়স্থলে বসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাফওল্যের খবরাখবর প্রচার ও জনমত গঠনে ও মাধ্যমে দেশবাসীর মনোবল বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। যেসব দৈনিক পত্রিকা নিয়মিত যুদ্ধের খবর ছাপতো সেগুলোর মধ্যে সংবাদ জাগরণ, গনরাজ, রূদ্রবীনা, নাগরিক জনপদ ছিল অন্যতম। এছাড়া সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে ছিল সমাচার, দেশের কথা, সীমান্ত প্রকাশ, ও ত্রিপুরার কথা। প্রথম দিকে এসব পত্রিকা বাংলাদেশে থেকে পালিয়ে আসা লোকদের স্মৃতি নির্ভর রিপোর্ট করতো। পরবর্তীতে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে রিপোর্টার পাঠিয়ে যুদ্ধের চলমান সংবাদ পরিবেশন করতো। ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত সমাচার পত্রিকাটির কথা এখনও মুক্তিযোদ্ধারা ভুলতে পারেন না। এ সম্পাদক ছিলেন শ্রী অনীল ভট্টাচার্য । তিনি দৈনিক যুগান্তরের ত্রিপুরা প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি শুধু সাংবাদিক ই নন বাংলাদেশ থেকে আসা স্মরণার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমা সাংবাদিকদের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে বিবিসি বাংলা এ এক্ষত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বিদেশী সাংবাদকগণ আসা শুরু করেন ৭০ এর ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ও জলোচ্ছাসকে কেন্দ্র করে। তারপর তারা ৭০ এর নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্কংুশ বিজয় প্রত্যক্ষ করেন।পাকিস্তান সরকারের সাথে যাদের মদদ ছিল তারা বাঙ্গালীর স্বাধীনতার চেতনাকে মূল্যায়ণ না করলেও অধিকাংশ মিডিয়া বাঙ্গালীর পক্ষে ছিল। তারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গনহত্যা সাপের্টি করেনি। যুগোশ্লাভিয়ার সংবাদপত্র লিখেছে, “ ইয়াহিয়া বেয়নেট দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে চাইছেন। ঘানার পত্রিকা লিখেছে, বিশ্ব বিবেক এখনও জাগেনি। আমেরিকার পত্রিকাগুলো লিখেছে, মার্কিন অস্ত্রে পূর্ব পাস্তিানি মারা যাচ্ছে। সুতরাং দায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারেরও। এসময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো মুক্তিযুদ্ধের উপর গুরুত্বারোপ করে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচেছ ঃ“ চীন চায়না ভারতীয় উপমহাদেশে যুদ্ধ বেধে যাক, ” এ এফপি, পিকিং, নভেম্বর ১৫, “মুজিবের রাষ্ট্র্রদ্রোহের প্রকৃতি, দ্য সানডে টাইমস, জাম্বিয়া, ২২ আগস্ট, ১৯৭১, ভারত –পাকিস্তান উপমহাদেশ পরিস্থিতি, সানডে পোস্ট, নাইরোবি, ৩ অক্টোবর ১৯৭১, শরনার্থী সমস্যার সমাধান, মানিচি, ডেইলি নিউজ , টোকিও । যুদ্ধের সময় চলমান সংবাদের পাশাপাশি কিছু প্রবন্ধ- নিবন্ধ ও সম্পাদকীয় প্রকাশিত হতো। এগুলো জনগনকে উদ্ধিপ্ত করতো। ৩১ মার্চ ৭১ দৈনিক জয় বাংলার সমম্পাদকীয়তে বলা হয়-“ বাংলার মুক্তিবাহিনী , পুলিশ, আনসার, ও স্বেচ্ছাসেবকদের সহিত সর্বপ্রকার সহযোগীতা করবেন। মনে রাখিবেন হয় আমরা জয়ী হইব নতুবা ধ্বংস হইব। মাঝামাঝি আর কোন পথ নাই।” জয় বাংলার ১৬ ডিসেম্বরের শিরোনাম ছিল -ভেঙ্গেছে দুয়ার, এসেছে জোতির্ময়। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরি বাংলার বাণী পত্রিকায় “ঢাকা আমায় ঢাকে” শিরোনামে লিখতেন। সাপ্তাহিক বাংলাদেশ ২১ নভেম্বর সংখ্যার শিরোনাম ছিল রক্ত-সত্ত , ঈদের চাঁদ রক্তের সমুদ্রে। এবারের ঈদ রক্ত তিলকে শপথের দিন। রনাঙ্গনের সম্পাদকীয়তে বলা হয়-আমরা শান্তি চাই। কিন্তু কবরের শান্তি চাই না। এবার আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠা করব। আঘাতের পর আঘাত হেনে দস্যু-হানাদারদের খতম করব, জয় বাংলা।”মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার পত্রিকাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে মুজিবনগর ও মুক্তাঞ্চলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিক্ষিপ্তভাবে নিয়মিত/অনিয়মিতভাবে পত্র-পত্রিকা ও সংবাদ সাময়িকীগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হতো। এগুলো মুক্তিকামী জনতার মুখপত্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে পত্র-পত্রিকার অবদান অপরিসীম।
লেখক: মমিনুল ইসলাম মোল্লা,প্রভাষক, ক্যাম্পেনার সিডিএলজি , কুমিল্লা,

No comments