মুক্তিযুদ্ধে নারীর ত্যাগ, স্বীকৃতি ও কিছু কথা
মুক্তিযুদ্ধে নারীর ত্যাগ, স্বীকৃতি ও কিছু কথা
মমিনুল ইসলাম মোল্লা, সাংবাদিক, কলামস্টি ও সাহিত্যিক,কুমিল্লা ।।
মুক্তিযুদ্ধে নারীর ত্যাগ, স্বীকৃতি ও কিছু কথা
মমিনুল ইসলাম মোল্লা
”একদিন হঠাৎ করে পাক বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের যে ক্যাম্পে ছিলেন সে ক্যাম্পের সকল যোদ্ধা তখন অপারেশনের জন্য বের হয়ে গেছেন। তিনি আল্লাহকে ডাকতে শুরু করলেন। হঠাৎ খেয়াল হলো ঘরে ৪টি চাইনিজ রাইফেল ও একধামা গুলি আছে । এগুলো বাঁচাতে হবে। তার কোলে তখন ২ মাসের শিশু স্বাধীন, তিনি অস্ত্রগুলো নিয়ে পালাতে গিয়ে তার কোলের শিশুটি একটি গর্তে পড়ে যায়। ভাগ্য ভাল কাজের মেয়েটিও সাথে ছিল। সে তৎক্ষনাৎ শিশুটিকে পানি থেকে তুলে ফেলে। কিছুক্ষণ পরেই ক্যাম্পটি হানাদারদের দখলে চলে যায়” মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সাফিনা লোহানি বলেন-একজন বীরাঙ্গনা প্রিয়ভাষিনী বল্লেন -সেদিনের কথা, চোখের সামনে নারকীয় দৃশ্য। নারীদের আর্ত চিৎকার। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া বেঁচে ফিরে আসব এটা কখনও ভাবিনি। তবুও বেঁচে আছি। আমি আজ স্বাধীনতা পদক পেয়েছি। শ্রদ্ধার সঙ্গে এ পদক মাথা পেতে নিয়েছি। দীর্ঘদিন এক বুক কান্নার নদী বয়ে বেড়াচ্ছি। যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি হলে কিছুটা হলেও শান্তি পাব। এক জরিপে দেখা যায়, পাকিস্তানি সৈন্য সংখ্যা ছিল রক্ষাধিক। তাদের সাথে বেসামরিক বিহারি ছিল প্রায় ৪০ হাজার, দেশীয় রাজাকার ছিল অর্ধলক্ষাধিক । তাদের অধিকাংশই ছিল নারী লোভী। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় কয়েকটি ক্যান্টনমেন্ট ছাড়াও সহ¯্রাধিক ক্যাম্প ও ছাউনিতে প্রকাশ্যে গোপনে প্রতিদিন গড়ে ১৪০০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়। ভিক্ষুক সেজে পাক বাহিনির অবস্থান মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়ে দিতেন বাগেরহাটের মেয়ে মেহেরুন্নেসা মীরা। তার মূল দায়িত্ব ছিল ক্যাম্প পাহাড়া দেয়া। একদিন বিঞুপুর হাই স্কুল এর উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধারা রওয়ানা হন। মিরা আগেই গিয়ে খবর নেন । জানতে পারেন রাজাকাররা প্রস্তুত। তখন তিনি খাল পারাপারের সেতুটি সরিয়ে নেন। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা রক্ষা পান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল নারী পুরুষের মিলিত প্রচেষ্টা। এ যুদ্ধে অনেক নারী সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হন , কেউ কেউ হাসপাতালগুলোতে সেবিকার দায়িত্ব পালন করেছেন, কেউ কেউ গোলা বারুদ সংগ্রহ করেছেন। আবার কেউ কেউ যুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলে যুদ্ধকে বেগবান করেছেন। তারা পুরুষের পাশে থেকে সবসময় অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।? মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে প্রচারকাজেও মেয়েরা বিশেষ ভুমিকা পালন করেছিলেন। রাফিয়া আক্তার ডলি সহ অনেকেই সেদিন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসমুহে শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে উদ্ভুদ্ধ করা ও শিবিরগুলোতে খাবার ও কাপড় যোগাড়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। কিছু কিছু মহিলা পুরুষদের মতই ভারতের প্রশিক্ষণ শিবিরে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের বশিরহাটে ছিল এধরণের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এ মহকুমার টাকিতে ৯নং সেক্টরের মূল হেডকোয়ার্টার ছিল। মেজর জলিলের নেতৃত্বে এখানে একটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে শতাধিক নারীকে গুপ্তচরবৃত্তির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়া এখানে প্রাথমিক চিকিৎসার ট্রেনিং দেয়া হয়। মোসাম্মৎ সালেহা, সাজেদা ও ফরিদাসহ বহু নারী এখানে ট্রেনিং নিয়ে মক্তিযোদ্ধাদের সেবায় নিয়োজিত থাকেন। দেশের ভেতরও মহিলাদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা ছিল। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে মহিলাদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মরিচা হাউজের সামনে দুই শতাধিক মহিলা ঢামি রাইফেলস দিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। একাজে নেতৃত্তদানকারী মহিলাদের মধ্যে কল্যাণী ঘোষ, উমা, স্বপ্না রায়, বুলবুল মহলান বীনা, অমিতা বসু, ফ্লোরা আহমেদ ও ফেরদৌসি মজুমদারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।কেউ কেউ জীবনের গøানি নিয়েই বেঁছে আছেন। এমনই একজন গাজীপুরের মমতাজ। তিনি গণধর্ষণের শিকার হন। ধর্ষণের ফলে তার প্র¯্রাবের রাস্তা ও পায়খানার রাসাতা এক হয়ে যায়। পরে পেটে পাইপ বসিয়ে প্রাকৃতিক কাজ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে তিনি এখনও পুরোপুরি সুস্থ নন। তার চিকিৎসা করতে গিয়ে তার স্বামী সর্বশান্ত হয়ে গেছেন। তিনি একজন সচ্ছল কৃষক ছিলেন। এখন তিনি জমি-জমা বিক্রি করে ভুমিহীন কৃষকে পরিনত হয়েছেন। মমতাজের খবর কেউ নেননি। এমনইভাবে একাত্তরের দুঃখ বয়ে বেড়াচ্ছেন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের খঞ্জনী বেগম, কুষ্টিয়ার দুলজাহানন্নেছা ও বরগুনার আমিরুন্নেছা।একাত্তরের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কতজন নারী অত্মহত্যা করেছেন এর কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কেউ ক্যাম্প থেকে বের হয়ে আত্মহত্যা করেছেন আবার কেউবা আত্ময়-স্বজন কর্তৃক ধিকৃত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এছড়া বহু নারী প্রাণ বাঁচাতে পতিতার খাতায় নাম লিখিয়েছেন। বীরাঙ্গনার পাশাপাশি তাদের সন্তানরাও বিরম্বনার শিকার হচ্ছে। প্রতিটি পদে পদে তাদেরকে লাঞ্ছনা আর গঞ্ছনার শিকার হতে হচ্ছে। যা আদৌ কাম্য নয়। কেননা আমাদের সমাজ তাদেরকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না। একজন বীরাঙ্গনা বল্লেন , মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে তাকে গার্ড অব অনার দিয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। সবাই মিলে তার রুহের মাগফেরাত কামনা করা হয়। তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি সবাই সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। কিন্তু একজন বীরাঙ্গনা মারা গেলে তার জানাযা হয় না। সঠিকভাবে দাফন হয় না। এর চেয়ে কষ্ট আর কী হতে পারে?
যারা আর্থিকভাবে সমস্যায় আছেন তাদের বক্তব্য হচ্ছে, জীবনই যখন চলছেনা সেখানে এত লজ্জা-শরম রেখে লাভ কী? মুখ বুঝে থাকার জন্যই এতদিন পর্যন্ত স্বীকৃতি মেলেনি। কেউ কেউ বলছেন তারাতো আমাদেও মতই মানুষ। তাদের যে কোন নামেই আলাদা করা হোক না কেন এটা তাদের জন্য উপকারী হবে না। তারা আমাদেরই মা-বোন, তাদেরকে আমাদের থেকে আলাদা করার প্রয়োজন নেই। এছাড়া একটু ভিন্ন দৃষ্টি দেয়া মানেই একটু ভিন্ন ফ্লেভার দেয়। তাই তাদেরকে অন্য ৮/১০ জন নারীর মতই সাভাবাভিকভাবে চলতে দেয়া উচিত।
বীরাঙ্গনাদের সামাজিক মর্যাদা রক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছেন সিরাজগঞ্জের সাফিনা লোহানী। তিনি সিরাজগঞ্জ উত্তরণ মহিলা সংগঠনের মাধ্যমে তাদের উজ্জিবীত করার চেষ্টা করছেন। যেসব বীরাঙ্গনা নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য এ সংগঠন আন্দোলন করছেন। জাতীয় নারী শ্রমিক জোটের দাবী-মুক্তিযোদ্ধার মা ও মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারী হচ্ছে দেশের শ্রেষ্ঠ নারী। সেই নারীদের স্বীকৃতি না দিলে স্বাধীনতা অর্জণ অপূর্ণ থেকে যাবে। নারী মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনা নারীদের নিয়ে কয়েকটি সংগঠন কাজ করছে। তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে ”নারী কণ্ঠ ফাউন্ডেশন” । তাদের সংগৃহীত তথ্যে দেখা গেছে -যুদ্ধকালীন নয় মাসে বাংলাদেশে সম্ভ্রম হারানো নারীর সংখ্যা ২ লাখ নয় ৪ লাখ। ৮ বছর বয়সের কিশোরী থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধা ও সেদিন পাক সেনাদেও লালসার শিকার হয়েছেন। গরীব-ধনী কেউই সেদিন রক্ষা পায় নি। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে বিভিন্ন সময় চিত্র প্রদর্শনী করা যেতে পারে। কিছুদিন আগে :নারী মুক্তিযোদ্ধা ও একাত্তরের নারী” নামক একটি চিত্র প্রদর্শনীতে দেখানো হয়েছে , মক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ছিল বহুমাত্রিক। এতে মুসলমান. হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ও আদিবাসি নারীরাও অংশগ্রহণ করেছে। ছোট ও বড় পর্দায় নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান ফুটিয়ে তুলতে যে কজন সাহসী এগিয়ে এসেছেন তাদের মধ্যে শামীম আক্তার অন্যতম। তিনি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। তিনি ১৯৯৯ সালে যুদ্ধ শিশুদের নিয়ে তৈরি করেন ”ইতিহাস কন্যা।”।বীরাঙ্গনারাও বীর, তারাও মুক্তিযোদ্ধা, তাদেরও আছে সম্মান, । তাদের নিয়ে তিনি তৈরি করেন ঐতিহাসিক ছবি ”বীরাঙাগনাগাঁথা” ও ”বীর থেকে বীরাঙ্গনা ”। এছাড়া তৈরি করেছেন ফিল্ম ফিচার ”নারী ও মুক্তিযুদ্ধ”। স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস এলেই আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নানা আয়োজনে মেতে উঠে। বক্তৃতা, বিৃতিতে কথার ফুলঝুড়িতে মেতে উঠে চারপাশ। তখনও কিন্তু শহীদ মুক্তিযোদ্ধা , যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আর জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বেশিরভাগ আলোচনা হয়। কিন্তু নারী যোদ্ধাদের (যারা সম্ভ্রম হারিয়েছেন) নিয়ে তেমন কোন আলোচনা হয় না বল্লেই চলে। অর্থাাৎ সেদিনও তারা অবহেলিত । এর চেয়ে দুঃকজনক আর কী হতে পারে? লেখকঃ প্রভাষক, সাংবাদিক ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের জন্য ক্যাম্পেনার।
মমিনুল ইসলাম মোল্লা, সাংবাদিক, কলামস্টি ও সাহিত্যিক,কুমিল্লা ।।
No comments