নগর কৃষি নিয়ে এক্ষুণি ভাবতে হবে
নগর কৃষি নিয়ে এক্ষুণি ভাবতে হবে
মমিনুল ইসলাম মোল্লা,সাংবাদিক,কলামিস্ট,কুমিল্লা।।
নগর কৃষি নিয়ে এক্ষুণি ভাবতে হবে
মমিনুল ইসলাম মোল্লা,
বাংলাদেশে নগরায়ন দ্রুতগতিতে হচ্ছে। কমে যাচ্ছে গ্রাম।সুজল –সুফলা, শস্য শ্যমলা বাংলাদেশ পরিনত হচ্ছে ইট পাথরের নগরীতে। আমাদের চোখের সামনেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে ধানের ক্ষেত, খেলার মাঠ। মানুষ নির্দ্ধিধায় কেটে ফেলছে গাছ-বৃক্ষ-তরুলতা, ভরাট করছে মাছের পুকুর-ফসলি জমি, তার পরিবর্তে গড়ে উঠছে বিল্ডিং, মার্কেট, শিল্প কারখানা। ফলে আবাদি জমি কমছে, কমছে কৃষি নির্ভর জনসংখ্য। ফলে গ্রাম্য চাষাবাদের পাশাপাশি নগরীয় চাষাবাদ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। নগরীয় কৃষি ছাড়া ভবিষ্যতের নগরীয় বাংরাদেশকে চিন্তা করা যায় না। বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে নগরীয় কৃষি ও গ্রামীণ কৃষি উভয়ের সহুযোগীতা প্রয়োজন। ১০ হাজার বছর আগে মিসর, মধ্যপ্রাচ্য, ও ভারতবর্ষের উর্বর ভূমিতে সর্বপ্রথম কৃষিকাজ শুরু হয়। প্রথম দিকে ধানের আবাদ ছিলনা। মানুষ খাদ্যশস্য হিসেবে গম, বার্লি ,কণর্, মটর, মসুর ও ছোলার চাষ করত। বাংলাদেশের ৯০% মানুষ প্রত্যেক্ষ বা পরোক্ষভাবেকৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল। এখন সে হার অনেক কমে গেছে। কৃষি শুমারি ২০০৮ অনুযায়ী ১৯৮৩-৮৪ সালে গ্রামাঞ্চলে কৃষি পরিবারের সংখ্যা ছিল ৭২.৭০ শতাংশ। এসংখ্যা ২০০৮ সালে কমে হয়েছ ৫৬.৭৪শতাংশ। বছরে প্রায় ৫ শতাংশ লোক অকৃষি পেশায় চলে যাচ্ছে। ১৯৯৫-৯৬ থেকে ২০০৫-০৬ সালে অকৃষি পেশার সংখ্যা ৮ লাখ থেকে ১২ লাখে হয়েছে। আন্তর্জাতিক হিসেব অনুযায়ী খাদ্য নিরাপত্তায় অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট প্রকাশিত বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার ব্যাপারে যে চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে ১০০ এর মধ্যে ৩৪ দশমিক ৬ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ ৮১ তম অবস্থানে রয়েছে। নগরীয় কৃষি নিয়ে নগর সরকারকে ভাবতে হবে। বর্তমানে আমাদের দেশের নগরীয় কর্তৃপক্ষ সাধারণত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মশা নিধন, সড়ক, ফুটপাত, ড্রেন নির্মাণ, ড্রেন সংস্কার, সড়ক বাতি, কবরস্থান, শ্মশানঘাট, সংরক্ষণ, বিপনি বিতান,পরিচালনা, আন্ত:বাস টার্মিনাল, স্বাস্থ্যসেবা, শরীরচর্চা কেন্দ্র, জাদুঘর, কমিউনিটি সেন্টার, লাইব্রেরী, খেলার মাঠ, ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে ব্যস্ত। এসব কাজের পাশাপাশি নগরীয় কৃষি নিয়েও নগর সরকারকে ভাবতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে *********–টি পৌরসভা ও ১০টি সিটি কর্পোরেশন রয়েছে। এগুলো নগর কৃষির সম্প্রসারণে সহযোগিতা করতে পারে। নগরবাসীর আর্থ সামাজিক উন্নয়নের লক্ষে কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন, কৃষি বিষয়ক জরিপ চালনা, বাঁধ ও পানি নিষ্কাশন, উন্নত সার বীজ ও কীটনাশক ওষধ সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিতকরন ও নগরীয় কৃষি সম্পর্কিত প্রদর্শনী প্লট তৈরিতে ব্লক সুপাভাইজারদের সহযোগিতা করতে পারে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে (৯৬) খাদ্য নিরাপত্তা হচ্ছে- যা মানুষের জন্য সব সময়ের জন্য পর্যাপ্ত , নিরাপদ, এবং পুষ্টিকর খাদ্যের লভ্যতা, যার ফলে তারা তাদের পথ্যের অভাব এবং খাদ্যের অভিরুচি ও অগ্রাধিকার মিটিয়ে একটি কর্মঠ ও স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করতে পারে। বিবিএস ২০০৭ অনুযায়ী দেশে নীট ফসলী জমির পরিমান ৮০.৩১ লক্ষ হেক্টর। এর মধ্যে এক ফসলি ৩৫.৮০%, দুফসলি ৫১.৪৫% আর ৩ ফসলি জমির পমিান ১২.৭৫%। বাংলাদেশে চাল উৎপাদন হার চীন, ভিয়েতনাম, ও ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় ৪৫%, ২০%, ও ২৫% কম। দেশে খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ায় দেশে দ্রব্যমূল্যের দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে ২০০৫ সালে থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত চালের মূল্য শতকরা ১০০ ভাগ বেড়েছে এবং গমের মূল্য ৬৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে জনসংখ্যা ১৬ কোটি। প্রতি বছর ২৫ লক্ষ নতুন মুখ আমাদের মিছিলে শরীক হয়। আর তাদের জন্য প্রতি বছর সাড়ে ৩ লাখ টন বাড়তি চালের দরকার হয়। ২০৩০ সালে দেশের জনসংখ্যা হবে ১৯ কোটি। তখন ৪ কোটি টন খাদ্যের প্রয়োজন হবে। তাই বর্তমানে হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন ২.৮ টন হতে ৪ টনে নিয়ে যেতে হবে।২০৫০ সালে জনসংখ্যা কত হবে তা পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণের উপর নির্ভরশীল। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের তথ্যানুসারে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহনকারীর সংখ্যা যদি ৭২ শতাংশে উন্নিত করা যায় তাহলে জনসংখ্যা হবে ২২ কোটি। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে দেশের ৫০% লোক বছরে কোন না কোন সময় খাদ্য ঘাটতিতে পড়ে। ২৫% লোক নিয়মিত খাদ্য ঘাটতিতে পড়ে এবং ৭% লোক ৩ বেলা খেতে পায় না। মাত্র ২৫% লোক প্রয়োজনীয় খাদ্য শক্তি পায় মাত্র ১ ভাগ লোক ভিটামিন বি এবং ২৩% লোক ভিটামিন সি এর চাহিদা পূরণ করতে পারে। এক হিসেবে দেশের ১৫ কোটির মধ্যে প্রায় ১ কোটি লোক দিনে ৩ বেলা খেতে পায় না। ১৯৭৮ সালে টমাস ম্য্যালথাস ভবিষ্যৎবানী করেছিলেন যে, এক সময় অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে যাবে পৃথিবীকে তার ধারণ ক্ষমতার বাইরে। এএফপি ২০০৮ সালে খাদ্য ঘাটতির ব্যাপারে একটি রিপোর্ট পেশ করে। এতে বলা হয় বিশ্বে ৩৩ টির ও বেশি দেশে তীব্র খাদ্য সংকট চলছে। যার ফলে বিরাজ করছে গন-অসন্তোষ। ৩৩ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
বগুড়ার শেরপুরের ছোনকা গ্রামর চিত্র আর আগের মতো নেই। নগরায়নের কারণে তা প্রতিনিয়ত পাল্টে যাচ্ছে। সিমেন্ট, তেলের মিল, চালের কল, মুরগির খামার, মাছের খামার, ইটের ভাটা, খেয়ে ফেলছে আবাদি জমি। এলাকার চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, গ্রাম এবং আশেপাশের কৃষি জমি বিক্রি হয়ে গেছে নয়তো বিক্রির প্রক্রিয়ায় আছে। গত ৫ বছরে এ গ্রামের ৬০০ বিঘা কৃষি জমি চলে গেছে অকৃষি খাতে। শুধু ছোনকা নয় উপজেলা সদরের অধিকাংশ গ্রামের একই চিত্র লক্ষ করা যাচ্ছে। ভুমি জরিপ বিভাগের তথ্য অনুযাযী ১৯৭১ সালে আমাদের আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ হেক্টর। ১৯৮৬ সালে তা কমে হয় ৮১ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর ২০০৩ সালে ৭০ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর। বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ৩২০ হেক্টর জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। ফলে ১৫ লক্ষ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তা হারাচ্ছে। কৃষি শুমারি ১৯৮৪ ও ২০০৮ এর মধ্যে তুলনা করলে দেখা যায় এ সময়ে আবাদি জমি কমেছে ৩৩ হাজার একর। অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য স্বাভাবিকভাবেই ঘর-বাড়ি তৈরি করতে হচ্ছে। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী তখন দেশে ঘর-বাড়ি ছিল ২ কোটি সাড়ে ৪৮ লাখ। ২০০৮ সালে তা দাঁড়ায় ২ কোটি ৮৬ লাখ ৭০ হাজার। আর বর্তমানে ঘর-বাড়ির সংখ্যা ৩ কোটি২১ লাখ ৭৩ হাজার ৬৩০ টি। এছাড়া রাস্তা-ঘাট , ব্রিজ-কালভার্ট এর মাধ্যমেও আবাদি জমি নষ্ট হচ্ছে। অর্থনেতিক সমীক্ষা ২০১২ অনুযায়ী ২০০১ সালে দেশে জাতীয় মহাসড়কের পরিমাণ ছিল ৩০৮৬ কিলোমিটার। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৩৫৩৮ কিলোমিটার। আঞ্চলিক মহাসড়ক ছিল ১৭৫১ যা বেড়ে হয়েছে ৪০৭৬ কিলোমিটার। ২০২০ সালে উন্নয়নশীল দেশের বিশেষ করে আফ্রিকা, এশিয়া, ও ল্যাটিন আমেরিকার জনসংখ্যার শতকরা ৭৫ ভাগ লোক নগরে বসবাস করবে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৫ কোটি লোক নগরে বসবাস করছে। ২০২০ সালে তা হবে***আর ২০৫০ সালে গোটা বাংলাদেশ নগরীয় বাংলাদেশে পরিনত হবে। তাই নগরীয় কৃষিকে উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই। যেসব দেশে ইতিমধ্যে নগরায়ন সম্পন্ন হয়েছে, সেসব দেশের লোকেরা ইতিমধ্যে নগরীয় কৃষিতেও বেশ এগিয়ে গেছে। হারারে নগরের স্বল্প আয়ের লোকজন যে পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে তার শতকরা ৬০ ভাগ আসে নগরীয় কৃষি থেকে। ক্যাম্পালা শহরের লোকজন তাদের বাগানে উৎপাদিত পণ্যের মাধ্যমে ৫০% চাহিদা পূরণ করে। ডাকারের জনসাধারণ তাদের প্রয়োজনীয় ৬০% শাক-শব্জি নগরীয় কৃষির মাধ্যমে লাভ করে। এছাড়া হ্যানয়ে বসবাসকারী লোকজন তাদের চাহিদা মোতাবেক মাছ, মাংশ ও শাক-সব্জি নগরীয় খামারগুলোতে উৎপাদন করতে সক্ষম হচ্ছে। (সূত্রঃ নিতাই চন্দ্র রায় )বাংলাদেশের ঢাকা শহরের বিভিন্ন এরাকায় প্রাথমিক পর্যায়ে ছাদে শাক-সব্জির চাষ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে সাভার ব্যাংক টাউন, সবুজ বাছা ,ছায়াবিথি, ও শাহীবাগ এলাকার ছাদে ছাদে এখন শীতকালীন সব্জি শোভা পাচ্ছে। আমরা হয়তো ছাদে ধান,আলু চাষ করতে পারবোনা তবে প্রয়োজনীয় সব্জি চাষ করতে বাধা নেই। এছাড়া নগরে পরিকল্পিতভাবে মাছ , ও মুরগীর খমার, গরু মোটাতাজাকরন, ও গুরুর দুধের খামার সহজেই করতে পারি। এগুলোও কৃষির অংশ।
লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক ও সাংবাদিক, কুমিল্লা। সধসরহসড়ষষধয@ুধযড়ড়.পড়স
No comments