পবিত্র আশুরার তাৎপর্য ও শিক্ষা
পবিত্র আশুরার তাৎপর্য ও শিক্ষা
মমিনুল ইসলাম মোল্লা, সাংবাদিক, কলামস্টি ও সাহিত্যিক,কুমিল্লা ।।
পবিত্র আশুরা, মহরম মাসের ১০ তারিখ। মুসাঃ এর ঘটনার কারণে এ দিনটি বিজয়ের দিন হিসেবে চিহ্নিত। অন্যদিকে কারবালার ঘটনার কারণে মুসলিম বিশ্বের জন্য শোকাবহ দিন আজ। এ দিন নবীজীর দৌহিত্র ইমাম হোসেন ( রাঃ) শাহাদাতবরণ করেন। তবে মুসলিম সমাজে বর্তমানে এটি শোকের দিন হিসেবেই বহুল প্রচলিত। এদিনটি মুসলমানরা অত্যন্ত মর্যাদার সাথে পালন করেন। নফল রোজাসহ কেরান তিলাওয়াত ও ইবাদত- বন্দেগির মাধ্যমে দিনটি অতিবাহিত করেন। এ দিন বাংলাদেশের মসজিদে -মসজিদে আলোচনাসভা, জিকির ও মিলাদ - মাহফিলের আয়োজন করা হয়। আমাদের সমাজে এদিনটি সম্পর্কে কিছু ভুল বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। এগুলো হচ্ছে ঃ এ দিন সবকিছু সৃষ্টি করা হয়েছে। এ দিন তাওরাত লাভের জন্য মুসা (আঃ) তুর পাহাড়ে গিয়েছিলেন। এ দিন কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। এদিন মিরাজ ও নবীজির জন্ম হয়েছিল। এ ধরণের আকিদার পেছনে কোরান ও হাদীসের কোন সহিহ দলীল নেই। এছাড়া আরো অরো কিছু কথা আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে, মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) কে এ দিন সৃষ্টি করা হয়। হযরত নুহ ( আঃ ) মহাপ্লাবন থেকে রক্ষা পান। হযরত ইব্রাহীম া (আঃ )ভূমিষ্ট হন। এদিন তিনি নমরুদের আগুনের কুন্ডলী থেকে অক্ষত অবস্থায় বের হন। হযরত আইয়ুুব ( আঃ ) কঠিন রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করেন। হযরত ইউনুস ( আঃ ) মাছের পেট থেকে রক্ষা পান। এ ধরণের ধারণায় বিশ্বাস করার মত কোরান ও সহিহ হাদিসে তেমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
পবিত্র আশুরার ব্যপারে বোাখারী ও মুসলিম শরীফে বহু হাদিস রয়েছে। এছাড়া কুরআন শরীফেও মুসা (আঃ) এর ঘটনার প্রেক্ষিতে আয়াত নাযিল হয়েছে। হযরত মুসা (আঃ) এর প্রতিপক্ষ ফেরাউন সম্পর্র্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, অতঃপর আমরা মুসাকে আদেশ করলাম, তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রকে আঘাত করো। ” আঘাতের ফলে সমুদ্রে সৃষ্ট রাস্তা দিয়ে মুসার দল নীল নদ অতিক্রম করেন। অন্যদিকে ফিরাউনের দলটি পানিতে ডুবে মারা যায়। সূরা আরাফ এ বলা হয়েছে- “ আর যে জাতিকে দুর্বল মনে করা হতো আমি তাদেরকে যমীনের পূর্ব ও তার পশ্চিমের উত্তরাধিকারী বানালাম, যেখানে আমি বরকত দিয়েছি। এং বনী ইসরাইলের উপর তোমার রবের উত্তম বাণী পরিপূর্ণ হল। করাণ তারা ধৈর্য ধারণ করেছে। আর ধ্বংস করে দিলাম যা কিছু তৈরি করেছিল ফিরাউন ও তার কওম এবং তারা যা নির্মাণ করেছিল।” এ দিন রোজা রাখা সুন্নত। “ রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহরম মাসের রোজা। এ রোজার তাৎপর্য অনেক বেশি। সহিহ হাদিসে আছে- নবীজি বলেন- আশুরার দিনের রোজার ব্যপারে আমি আল্লাহর কাছে আশা করি তিনি পূর্ববর্তী একবছরের পাপ ক্ষমা করে দেবেন।”
বুখারি শরীফে ( হাদিস নং ১৮৬৫ ) বর্ণিত আছে- রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) মদিনায় আগমন করে দেখতে পেলেন সেখানকার লোকেরা আশুরার দিন রোজা পালন করছে। নবীজি বল্লেন এটি কী ? তারা বল্ল , এটি একটি ভাল দিন। এ দিনে আল্লাহ তায়ালা বনি ইসরাইলকে তাদের দুশমনের কবল থেকে আল্লাহ রক্ষা করেছেন। তাই মুসা ( আঃ ) রোজা পালন করেছেন। রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) বল্লেন- মুসাকে অনুসরণের ব্যপারে আমি তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার। অতঃপর তিনি রোজা রেখেছেন এবং রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। ” এসময় একাধিক রোজা রাখা যেতে পারে। নবীজি বলেছেন- “ যদি আমি সামনের বছর বেঁচে থাকি তাহলে অবশ্যই মুহরমের ৯ তারিখে রোজা রাখব।”(মুসলিম) এছাড়া মুসলিম শরীফে আরো বলা হয়েছে (হাদিস নং ১৯৮২ )কারবালায় ফোরাৎ নদীর তীরে ইয়াজিদ বাহিনীর কাছে ইমাম হোসাইনের পরাজয় ও মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাজিয়া মিছিল বের করা হয়। এতে কিছু সংখ্যক আশেকান জোরে জোরে বুক চাপরিয়ে পোশাক ছিড়ে, তলোয়ার বা ছুরি দিয়ে শরীর রক্তাক্ত করে হায় হুসাইন! হায় হুসাইন! ঊলে উচ্চস্বরে একত্রে বিলাপ করে। এটি শরীয়ত সম্মত নয়। উম্মে আতিয়া (রাঃ ) থেকে বর্ণিত যে, রসিুলুল্লাহ ( সাঃ ) বাইয়াত গ্রহণকালে আমাদের থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যেন আমরা মৃত ব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশার্থে উচ্চ শব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে কান্নাকাটি না করি।”অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, উম্মে আতিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন- আমাদেরকে তিনদিনের বেশি শোক পালন করতে নিষেধ করা হয়েছে। শুধুমাত্র স্বামী মারা গেলে স্ত্রীদের জন্য চারমাস দশ দিন শোক পালন করতে হয় ( বোখারি ৫৩৪০)। হযরত মুসা (আঃ ) এর ঘটনার প্রেক্সিতে ১০ মহরম শোকের নয় আনন্দের দিন। তবে এ দিনে বিজয়ের আনন্দ - উল্লাস , হৈ-চৈ করা যেমন সমর্থনযোগ্য নয় ; তেমনি কারবালার ঘটনার কারণে দিনটিকে আমরা স্মরণ করলেও তাজিয়া মিছিলের প্রয়োজন নেই। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হবে অবনতচিত্তে, বিগলিত অন্তওে, অবনত মস্তকে সিজদা ও সাওম আদায়ের মাধ্যমে । এগুলো থেকে নিজে বিরত থাকা এবং অন্যদের বিরত রাখা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব।
লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা, প্রভাষক ও ধর্মীয় গবেষক, কুমিল্লা।০১৭১১৭১৩২৫৭ maminmollah@yahoo.com
No comments