প্রশ্নোত্তরে শবেবরাতের পরিচয় ও কিছু কথা


মমিনুল ইসলাম মোল্লা, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও প্রদায়ক,কূমিল্লা।।

 আরবী শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে সাধারণভাবে শবেবরাতবা লায়লাতুল বারাআত’ (ليلة البراءة ) বলা হয়। শবেবরাতশব্দটি ফারসী। এর অর্থ হিস্সা বা নির্দেশ পাওয়ার রাত্রি। দ্বিতীয় শব্দটি আরবী। যার অর্থ বিচ্ছেদ বা মুক্তির রাত্রি। এদেশে শবেবরাত সৌভাগ্য রজনীহিসাবেই পালিত হয়।

®¥ ভাগ্য রজনী বলা হয় কেন?

লোকেরা ধারণা করেন যে, এ রাতে বান্দাহর গুনাহ মাফ হয়। আয়ু ও রূযী বৃদ্ধি করা হয়, সারা বছরের হায়াত-মউতের ও ভাগ্যের রেজিষ্ট্রার লিখিত হয়।

®¥ কবরে আলোকশয্যা করা হয় কেন ?

অনেকে মনে করে এই রাতে রূহগুলো সব আত্মীয়-স্বজনের সাথে মুলাক্বাতের জন্য পৃথিবীতে নেমে আসে। বিশেষ করে বিধবারা মনে করেন যে, তাদের স্বামীদের রূহ ঐ রাতে ঘরে ফেরে। এজন্য ঘরের মধ্যে আলো জ্বেলে বিধবাগণ সারা রাত মৃত স্বামীর রূহের আগমনের আশায় বুক বেঁধে বসে থাকেন। বাসগৃহ ধুপ-ধুনা, আগরবাতি, মোমবাতি ইত্যাদি দিয়ে আলোকিত করা হয়।

®¥ ১০০ রাকাত নামাজ পড়ার নিয়ম কি ?

এ রাতে অগণিত বাল্ব জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়। এজন্য সরকারী পুরস্কারও ঘোষণা  করা  হয়।  আত্মীয়রা  সব  দলে  দলে  গোরস্থানে  ছুটে  যায়। হালুয়া-রুটির হিড়িক পড়ে যায়। ছেলেরা পটকা ফাটিয়ে আতশবাজি করে হৈ-হুল্লোড়ে রাত কাটিয়ে দেয়। যারা কখনো ছালাতে অভ্যস্ত নয়, তারাও ঐ রাতে মসজিদে গিয়ে ছালাতে আল্ফিয়াহ (الصلاة الألفية ) বা ১০০ রাকআত ছালাত আদায়ে রত হয়, যেখানে প্রতি রাকআতে ১০ বার করে সূরায়ে ইখলাছ পড়া হয়।

®¥ ”হালুয়া রুটি খাওয়ার প্রচল “ এর ভিত্তি কি ?

হালুয়া-রুটি সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, ঐদিন আল্লাহর নবী (ছাঃ)-এর দান্দান মুবারক ওহোদের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিল। ব্যথার জন্য তিনি নরম খাদ্য হিসাবে হালুয়া-রুটি খেয়েছিলেন বিধায় আমাদেরও সেই ব্যথায় সমবেদনা প্রকাশ করার জন্য হালুয়া-রুটি খেতে হয়। অথচ ওহোদের যুদ্ধ হয়েছিল ৩য় হিজরীর শাওয়াল মাসের ১১ তারিখ শনিবার সকাল বেলায়।সূত্রঃ বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত (বৈরুতঃ ১৯৮৫) ৩য় খন্ড, পৃঃ ২০১-২। আর আমরা ব্যথা অনুভব করছি তার প্রায় দুমাস পূর্বে শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রে...!

®¥ এই রাতে কুরআন নাযিলের কথাটি আসলো কিভাবে ?

ধর্মীয় ভিত্তি কতটুকু তা খুঁজে দেখব। প্রথমটির সপক্ষে যে সব আয়াত ও হাদীছ পেশ করা হয় তা নিম্নরূপঃ ১- সূরা দুখান-এর ৩ ও ৪ নং আয়াত-

إِنَّا اَنْزَلْنَاهُ فِى لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِيْنَ- فِيْهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍحَكٍِ-

অর্থঃ (৩) আমরা তো ইহা অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক রজনীতে; আমরা তো সতর্ককারী (৪) এই রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।৪ হাফেয ইবনে কাছীর (৭০১-৭৭৪ হিঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেন, ‘এখানে মুবারক রজনী অর্থ লায়লাতুল ক্বদর। যেমন সূরায়ে ক্বদর ১ম আয়াতে আল্লাহ বলেন,إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِىْ لَيْلَةٍ الْقَدْرِ-   অর্থঃ নিশ্চয়ই আমরা ইহা নাযিল করেছি ক্বদরের রাত্রিতে। আর সেটি হল রামাযান মাসে।

®¥ রিজিক বণ্টণের কথা বলা হয় কেন ?

এই রাতে এক শাবান হতে আরেক শাবান পর্যন্ত বান্দার রূযী, বিয়ে-শাদী, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি লিপিবদ্ধ হয় বলে যে হাদীছ প্রচারিত আছে, তা মুরসাল ও যঈফ এবং কুরআন ও ছহীহ হাদীছ সমূহের বিরোধী হওয়ার কারণে অগ্রহণযোগ্য।

®¥ মানুষ সৃষ্টির পূর্বেই রিজিক লেখা হয়ে গেছে ?

আসমান সমূহ ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বৎসর পূর্বেই আল্লাহ তাআলা স্বীয় মাখলূক্বাতের তাক্বদীর লিখে রেখেছেন। হযরত আবু হুরায়রাহ (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমার ভাগ্যে যা আছে তা ঘটবে; এবিষয়ে কলম শুকিয়ে গেছে (পুনরায় তাক্বদীর লিখিত হবে না)। মুসলিম, মিশকাত হা/৭৯। এক্ষণে শবেবরাতে প্রতিবছর ভাগ্য লিপিবদ্ধ হয় বলে যে ধারণা প্রচলিত আছে, তার কোন ছহীহ ভিত্তি নেই। বরং লায়লাতুল বারাআত বা ভাগ্যরজনী নামটিই সম্পূর্ণ বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ইসলামী শরীআতে এই নামের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।

®¥ শরীআতে বিদআত কি ?

যুগে যুগে বৈষয়িক প্রয়োজনে সৃষ্ট বিভিন্ন আবিষ্কার সমূহ যেমন সাইকেল, ঘড়ি, চশমা, মটরগাড়ী, উড়োজাহায ইত্যাদি বস্ত্তসমূহ আভিধানিক অর্থে বিদআত বা নতুন সৃষ্টি হলেও শারঈ পরিভাষায় কখনোই বিদআত নয়। তাই এগুলোকে গুনাহের বিষয় বলে গণ্য করা অন্যায়। অনেকে এগুলোকে অজুহাত করে ধর্মের নামে সৃষ্ট মীলাদ, ক্বিয়াম, শবেবরাত, কুলখানি, চেহলাম ইত্যাদিকে শরীআতে বৈধ কিংবা বিদআতে হাসানাহ বলে থাকেন, যেটা আরো অন্যায়। বরং বিদআতকে দুভাগে ভাগ করাই আরেকটি বিদআত।

®¥ দিনে সিয়াম ও  রাতে কিয়াম করলে দোষ কি ?

এই উপলক্ষ্যে ছালাত ছিয়াম ও অন্যান্য ইবাদত অনুষ্ঠান মূলতঃ বিদআত হলেও কাজগুলো তো ভাল। অতএব বিদআতে হাসানাহ বা সুন্দর বিদআত হিসাবে করলে দোষ কি? এর জওয়াব হল এই যে, ইসলামী শরীআত কোন মানুষের তৈরী নয়। বরং সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর অহি দ্বারা প্রত্যাদিষ্ট। এর ইবাদত বিষয়ের সবটুকুই শরীআত কর্তৃক নির্ধারিত। যেখানে সামান্যতম কমবেশী করার অধিকার কারু নেই। আর শরীআতের মধ্যে নতুন কিছু সৃষ্টি করাকেই তো বিদআত বলা হয়। সকল বিদআতই ভ্রষ্টতা। যার পরিণাম জাহান্নাম।

®¥ ১০০ রাকাত সালাতের ব্যাপারে ইমাম নববী কি বলেন ?

হাফেয ইরাকী বলেন, মধ্য শাবানের বিশেষ ছালাত সম্পর্কিত হাদীছসমূহ মওযূ এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে মিথ্যারোপ মাত্র। ইমাম নবভী (৬৩১-৬৭৬ হিঃ) বলেন, ‘ছালাতে রাগায়েব নামে পরিচিত ১২ রাকআত ছালাত, যা মাগরিব ও এশার মধ্যে পড়া হয় এবং রজব মাসের প্রথম জুমআর রাত্রিতে ও মধ্য শাবানের রাত্রিতে ১০০ রাকআত ছালাত আদায় করা হয়ে থাকে, এগুলি বিদআত ও মুনকার।... এই ছালাতগুলি সম্পর্কে যত হাদীছ বর্ণনা করা হয়ে থাকে সবই বাতিল। কোন কোন আলেম এগুলিকে মুস্তাহাব প্রমাণ করতে গিয়ে যে কিছু পৃষ্ঠা খরচ করেছেন, তারাও এ ব্যাপারে ভুলের মধ্যে আছেন

®¥ ফজিলত সম্পর্কে চটি বইয়ের দলিল কি গ্রহণযোগ্য ?

মকছুদুল মোমেনীন (১৯৮৫) পৃঃ ২৩৫-২৪২ ইবং মকছুদুল মোমীন (১৯৮৫) ৪০২-৪০৮ পৃষ্ঠায় শবেবরাতের ফযীলত বলতে গিয়ে হাদীছের নামে যে ১৬টি বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে, তার সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।

®¥ তাহলে কি আমরা এটা বর্জণ করবো ?

শবেবরাত কোন ইসলামী পর্ব নয়। ঐ নিয়তে ছালাত-ছিয়াম, দান-ছাদাক্বা কিছুই আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। বরং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর তরীকা বিরোধী হওয়ার কারণে এবং ঐ উপলক্ষ্যে আয়োজিত বিদআতী অনুষ্ঠানাদিতে অর্থ ও সময়ের অপচয়ের কারণে আখেরাতে গ্রেফতার হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। অতএব বিদআত হতে বেঁচে থাকুন! আল্লাহ আমাদের সহায় হউন!

লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা, ইসলামী গ্রন্থ প্রণেতা,প্রাক্তন প্রভাষক , শাহতলী কামিল মাদ্রাসা,চাঁদপুর।maminmollah.xyz 1711-713257

No comments

Theme images by mammuth. Powered by Blogger.