কবর উঁচু করা সম্পর্কে ইসলাম
কবর উঁচু করা সম্পর্কে ইসলাম
মমিনুল ইসলাম মোল্লা কবরের কাছে গেলে মানুষের মন আখিরাতমুখী হয়। তখন মুসলমানরা ভাবেন, আজ যিনি শুয়ে আছেন কিছুকাল আগে তিনিও আমাদের মত হাঁটা-চলা করতেন, স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করতেন। আল্লামা বদরুদ্দিন আয়নী (রহঃ) বলেন, “কবর যিয়ারত ইসলামের প্রথম যুগে নিষেধ ছিল। কেননা সকল লোক (মুসলিম) কিছু কাল আগেও পুজায় অভ্যস্ত ছিল। তারা কবরকে ‘ইবাদতখানা ’ হিসাবে গ্রহণ করেছিল। অতঃপর যখন ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হল ঈমানের পক্ষে মানুষের অন্তর দৃঢ় হল তখন কবর যিয়ারতের অনুমতি দেয়া হলো। কবরস্থানকে কেন্দ্র করে মাসজিদ নির্মান করা হলে তাতে সালাত আদায় করার বিধান নেই। এখানে সালাত আদায় করলে তা শুদ্ধ হবে না। রাসুেল আকরাম (সাঃ) বলেছেন “ পৃথিবীর পুরাটাই মাসজিদ। তবে কবরস্থান ও গোসলখানা ব্যতীত ( ইবনু মাজাহ ৭৪৫ )। তাই কবরস্থানে রাসুল (সাঃ) নির্দেশিত দোয়া বাদে কোরান খতম, নামাজ কিংবা অতিরিক্ত ইবাদত করা যাবে না। কবরস্থানে গিয়ে কবরবাসীর জন্য কাঁদার অনুমতি রয়েছে। সাহাবাদের বর্ণনায় পাওয়া যায়, নবিজী (সাঃ ) একদিন নিজের মায়ের কবরে গেলেন। তিনি সেখানে নিজে কাঁদলেন এবং অন্যদেরকেও কাঁদালেন। তারপর বল্লেন, “আমি আমার মায়ের জন্য মাগফেরাত কামনা করতে আাল্লাহর কাছে অনুমতি চাইলাম। কিন্তু আমাকে অনুমতি দেয়া হলো না। তারপর আমি আমার মায়ের কবরের কাছে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। আমাকে অনুমতি দেয়া হলো । তাই তোমরা কবরের কাছে যাবে। কারন কবর মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ” কবরস্থানকে অন্যান্য সমতল ভূমি থেকে আলাদাভাবে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে পাথর অথবা শক্ত কোন জিনিস দিয়ে চিহ্ন দেয়া যায়। আলাদাভাবে সংরক্ষণ করা না হলে মানুষ অসাবধানতাবশত কবরের উপর দিয়ে হাঁটা চলা করতে পারে যা করার বিধান নেই। কেননা হাদিসে বলা হয়েছে মৃতের হাড় ভাঙ্গা জীবিতের হাড় ভাঙ্গার মত। যার ইমান নিয়ে মারা গেছেন তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতে হবে। তাই বিনা প্রয়োজনে জুতা পায়ে বা খালি পায়ে গিয়ে কোন অবস্থাতেই কবরের অমর্যাদা করা যাবে না। কবরস্থানের উপরে অথবা বাউন্ডারী ওয়ালে কোন কিছ দিয়ে ু লিখা, টাইলস বা পাথরে খোদাই করে কিছু লিখা নিষেধ। মৃত ব্যক্তির নাম, মৃত্যু তারিখ এমনকি কোরানের আয়াতও লিখা যাবে না। ইমাম যাহাবী ( রহঃ )বলেন- কোন সাহাবী থেকে এমর্মে জানা যায়নি যে, তারা কবরে কোন কিছু লিখেছেন। ইবনে হাজার আসকালানী বলেন- কবরের উপর যা কিছুই লিখ হোকনা কেন তা মাকরুহ। সুলায়মান ইবনু মুসা ( রহঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসে কবরের উপর লেখা থেকে বিরত থাকাতে বলা হয়েছে ( নাসাঈ ২০৩১)। কবরের নিকটে গরু ছাগল -মোরগ ইত্যাদি জবেহ করা নিষেধ। জাহেলী যুগে নেককার ও দানশীল ব্যক্তিদের কবরের পাশে এগুলি করা হতো ( আবু দাউদ-কিতাব আল আইমান আন নুযুর)। রাসুলে আকরাম (সাঃ) ১২ই রবিউল আউয়াল মৃত্যবরণ করেছেন। কোরানুল কারিমে বলা হয়েছে সকল মানুষই মৃত্যুবরণ করবে। এছাড়া রাসুল (সাঃ) এর ব্যাপারে খাসভাবে এসেছে সুরা যুমারএ। সেখানে বলা হয়েছে-“ তুমি মরণশীল এবং তারাও মরণশীল। ” তারপর রাসুল সাঃ এর বাণী আবু বকর (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবীগণ যেখানে মৃত্যুবরণ করেন সেখানেই তারা কবরস্থ হন (ইবনু মাজা ১৬২৮) অনুযায়ী তাকে আয়েশা (রাঃ) এর ঘরে দাফন করা হয়। (সিরাতুর রাসুল সাঃ ৭৫৩-৭৫৪)।
মহিলারা সাধারণভাবে কবর যিয়ারত করতে পারবেন।কবরের পাশে বিলাপ করে কাঁদা নিষেধ। রাসুল (সাঃ) একদিন এক মহিলার কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। মহিলাটি কবরের পাশে বসে ক্রন্দন করছিলেন। রাসুল (সাঃ) তাকে বল্লেন, “তুমি আল্লাহকে ভয় কর এবং ধৈর্যধারণ কর।” নারীদের কবর যিয়ারত সীমিত করা হয়েছে। কেননা নারী-পুরুষ একসাথে যিয়ারত করতে গেলে ফেতনা সৃষ্টি হতে পারে। আল্লামা বদরুদ্দিন আয়নী (রহঃ) বলেন, নারীদের কবর যিয়ারত নিষিদ্ধ করার কারণ-তাদের ধৈর্র্য শক্তি কম এবং দুঃখ প্রবণতা বেশি অর্থাৎ অল্পতেই ভেঙ্গে পড়ে। ইমাম বুখারি ( রহঃ ) নারীদের যিয়ারত নাযায়িজ বলে প্রমান করেছেন। অধিক কবর যিয়ারতকারিনী অভিশপ্ত বলে গন্য হবে। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুলে আকরাম (সাঃ )বেশি বেশি কবর যিয়ারতকারী মহিলাদের উপর অভিশাপ করেছেন ( তিরমিযি -ইফা ১০৫৬)। তবে কবর যিয়ারতে গেলে সেখানেও প্রয়োজনবশত পর্দা করতে হবে। বেপর্দভাবে শরিয়তি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এমন পোশাক পড়তে পারবেন না। জীবিত অবস্থায় যে লোকটি ধর্মীয় ক্ষেত্রে সম্মানিত ছিলেন মৃত্যুর পরও তাকে সে রুপ সম্মান দেখাতে হবে। কোন নেককার ব্যক্তির কবরে গেলে তাকে ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী সম্মান দেখাতে কোন আপত্তি নেই। আয়েশা (রাঃ) এর ঘরে নবিজীকে কবর দেয়া হয়েছিল। পরে সেখানে আবু বকর ও ওমর (রাঃ) কে কবর দেয়া হয়। তিনজনকে কবর দেয়ার পর আয়েশা (রাঃ) যখন সে ঘরে প্রবেশ করতেন তখন তিনি প্রত্যেককে তার মর্যাদা অনুযায়ী সম্মান জানাতেন। আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, আমি যখন সেই ঘরে প্রবেশ করতাম যেখানে রাসুল (সাঃ) শুয়ে আছেন তখন আমি আমার চাদর খুলে রাখতাম। আমি মনে মনে বলতাম, তিনি তো আমার স্বামী, আর অপরজন আমার পিতা, কিন্তু যখন ওমরকে এখানে তাদের সাথে দাফন করা হলো , আল্লাহর কসম , তখন থেকে আমি যখনই ঐ ঘরে প্রবেশ করেছি, উমরের কারনে লজ্জায় শরীরে চাদর পেচিয়ে রেখেছি ( আহমদ ২৫৬৬) । বোখারি -মুসলিমে আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত , ইম্মু হাবিবাহ ও উম্মু সালমাহ (রাঃ) গীর্জার আলোচনা করেন যা হাবাশায় তারা দেখেছেন, তাতে মূর্তি রয়েছে। এ বিষয়টি রাসুল (সাঃ) কে জানালে তিনি (সাঃ) বলেন, নিশ্চয় তাদের মধ্যে ভাল মানুষ ছিল। তারা যখন মারা যেত তাদের কবরের উপর মসজিদ বানাতএবং সেখানে তাদের মূর্তি বানাত। আর এরাই হলো কিয়ামতের দিনে আল্লাহর নিকট নিকৃষ্ট সৃষ্টিজীব। ইবনু হাজার বলেন, পূর্বের যুগের লোকেরা এমনটি করত যে তারা তাদের ছবি দেখে প্রশান্তি লাভ করত এবং স্মরণ করত তাদের নেক অবস্থাকে। আর তাদের মতো প্রচেষ্টা করত। এরপরে পরবর্তী প্রজন্ম আসল। পূর্ববর্তী লোকদেরকে উদ্দেশ্য ভুলে গেলে ,শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিলো যে, তোমাদের পূর্ববর্তীরা এ ছবিগুলোর ইবাদত করত এবং সম্মান করত। সুতরাং তোমরা এদের ইবাদত করো। অতঃপর রসুল (সাঃ) এ ব্যাপারে সতর্ক করলেন এবং এ পথকে বন্ধ করলেন উম্মতগণ যাতে অনুরুপ পরিবেশের দিকে ধাবিত যেন আর না হয়। রাসুল (সাঃ) চাননি তার কবরকে ঘিরে যেন কোন ইবাদত না করা হয়। আত্বা ইবনু ইয়াসার (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এ দুয়া করলেন, “হে আল্লাহ ! তুমি আমার কবরকে এমন করোনা যাতে লোকেরা ইবাদত করবে। আল্লাহর কঠিন রোষানলে পতিত হবে সে জাতি যারা তাদের নাবীর কবরকে মাসজিদে পরিণত করেছে।” হাদিসটি ইমাম মালেক মুরসাল সূত্রে বর্ণনা করেছেন। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মুফাস্সিরগণ বলেছেন, এ দুয়ায় “ ওয়াসান” শব্দের ব্যবহার ঘটেছে। ওয়াসান বলা হয় ঐ প্রত্যেক দেহ বা শরীরকে যা মণি- মানিক্য , কাঠ বা পাথর দ্বারা গঠন করা হয়। যাকে মানুষ সম্মান করে, বারবার সেখানে যায়। যেমনটা উপমহাদেশের বিভিন্ন যায়গায় দেখা যায়। সোয়াবের আশায় কোন ঐতিহাসিক কবর, কিংবা বিখ্যাত স্থানে সফর করা নিষেধ। মসজিদের ক্ষেত্রে ও নিষেধ মানা জরুরী। তবে ৩টি মসজিদে এ নিষেধের অন্তর্ভুক্ত নয়। এগুলো হচ্ছে মক্কার মাসজিদুল হারাম, মদিনার মাসজিদে নববী, এবং জেরুজালেমের মাসজিদুল আকসা ( বুখারি- ইফা ১১১৬)। মাসজিদে নববীতে নামাযের উদ্দেশ্যে গেলে নবিজীর কবরে সালাম পেশ করা যাবে। তবে নবিজীর মর্যাদা নিয়ে অতিরিক্ত ধারণা সফর পোষণ করা যাবে না। রাসুলে আকরাম (সাঃ) বলেন, “ তোমরা আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না। যেভাবে নাসারাগণ ঈসা (আঃ) সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করেছে ( জেয়ারতে মদিনা) আমি তো একজন বান্দা বৈ আর কিছুই নই। তোমরা বল যে, আমি আল্লাহর বান্দা ও রসুল ( বুখারি- ইফা ৩১৯৯)। বর্তমানে উঁচু কবরগুলোকে কেন্দ্র করে ইসলাম বহির্ভূত কার্যক্রম চলছে। নবিজী উঁচু কবরগুলোকে সমান করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া , আবু বকর ইবনু শায়বা ও যুহায়র ইবনু হারব রহঃ ...আবুল হায়াজ আসাদী (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আলি (রাঃ ) আমাকে বল্লেন, আমি কি তোমাকে ঐ কাজে পাঠাব যে কাজে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে পাঠিয়েছিলেন। কাজটা হলো সকল মূর্তিকে বিলুপ্ত এবং উঁচু কবরকে ভেঙ্গে দেবে ( সহিহ মুসলিম- ২১২৫) কবরবাসীকে অতিরিক্ত মর্যাদা দিলে শিরকের অপরাধে অপরাধী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে অধিকাংশ পাকা কবরে তাই হচ্ছে। কেউ কেউ কবরবাসীকে আল্লাহর সাথে শরীক করে তাকে। আল্লাহর কাছে কিছু পাওয়ার আশায় কবরবাসীর উসিলায় দোয়া করে থাকেন। কবরবাসীর কাছে দোয়া করা এবং বিপদাপদ দূর করার জন্য তাদের কাছে ফরিয়াদ করা বড় শির্কের অন্তর্ভূক্ত, যা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় ( জামেয়া তিরমিযি -১০৫২)। কবরের উপর ঘর ও গম্বুজ বানাতে নিষেধ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে হযরত ইবনু ইসহাক জাবের (রাঃ) বলেন, “ নাবি (সাঃ) কবর পাকা করতে তার উপর বসতে এবং তার উপর ইমারত নির্মান করতে নিষেধ করেছেন ( মুসলিম- ইফা ২১১৭)। কবরের উপরের অংশ পাকা করা কবরের উপরের কিছু লিখা বৈধ নয়। কবর পাকা করলে কবরবাসীকে অতিরিক্ত সম্মান প্রদর্শন করা হয়। কেউ যদি মৃত ব্যক্তির কাছে কিছু চায় তাহলে সেটি ঠিক হবে না। আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ ছাড়া আর যাদেরকে ডাক তারা তোমাদের মত বান্দা ”(সুরা আরাফ-১৯৪) ।
কবরস্থানে কিছু না চেয়ে তাদের মাগফেরাতের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতে হবে। তাদের কাছে কিছু চাওয়া যাবে না। রাসুলে আকরাম (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ বাদে অন্যকে তার সমকক্ষ বা অংশীদার মনে করে তার নিকট দোয়া প্রার্থনা করে আর ঐ অবস্থায় মারা যায় সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে (সহিহ বুখারি-ইফা ৪৪১২)। জামেয়া তিরমিজিতে সহিহ সূত্রে এসেছে প্রত্যেক আদম সন্তানই পাপী। আয়িশা (রাঃ) বলেন, যে দিন আমার ঘরে রাসুল (সাঃ) আসতেন, সেদিন শেষ রাতে উঠে তিনি “বাকীতে” ( মদিনার কবরস্থানে) চলে যেতেন। তখন তিনি বলতেন, হে আল্লাহ! বাকী গারক্বাদবাসীদেরকে মাফ করে দিন ( সহিহ মুসলিম-২৩০১) । বুরায়দাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত । রাসুলে আকরাম (সাঃ) কবরস্থানে গেলে একটি দোয়া পড়তেন তা হচ্ছে -“হে কবরবাসী মুমিন ও মুসলমান , তোমাদের উপর শান্তি বার্ষত হোক । ইনশাল্লাহ অবশ্যই আমরাও তোমাদের সাথে মিলিত হচ্ছি। আমরা আমাদের ও তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি ( মুসলিম ইফা - ২১২৬)।
লেখকঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক ও সাংবাদিক, ধর্মীয় গবেষক, কুমিল্লা।

No comments