মুসলিম পিতার প্রথম দায়িত্ব আকিকা করা

মুসলিম পিতার প্রথম দায়িত্ব আকিকা করা

মমিনুল ইসলাম মোল্লা 
পৃথিবী জুড়ে প্রতিদিন মুসলমান নারীদের কোলে আসছে নতুন অতিথি। সদ্য ভূমিষ্ট এ অতিথিদের ব্যপারে আমরা কতটুকু ইসলামী আদর্শ অনুসরণ করি ? সন্তানের জীবনের শুরুটাই যদি বিধর্মীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী হয় তাহলে তার সারা জীবন কীভাবে কাটবে ? সে কী প্রকৃত মুমিন হয়ে পিতা-মাতার জন্য দোয়া করবে ? মুসলমান পিতা-মাতা হিসেবে নবজাত সন্তানের প্রতি আমাদের কিছু কর্তব্য রয়েছে। প্রথমেই তার ডান কানে আযান দিতে হবে। একটি সুন্দর ইসলামী নাম রাখতে হবে। প্রথমদিনেই সেটি করা যেতে পারে। রাসূল  (সাঃ) বলেন , আজ রাতে আমার ১টি সন্তান  ভূ  ’মিষ্ট হয়েছে । আমি তাঁর নাম রেখেছি  “ইব্রাহিম ” ; আমার পিতা  ইব্রাহিমের নাম অনুযায়ী। ( মুসলিম )। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি তার সন্তানের আকিকা করতে চায় সে যেন উহা পালন করে। ( আহমাদ ও আবু দাউদ)।   বুয়াদা  (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ বলেন- ৭ম দিন অথবা ১৪তম দিন অথবা ২১তম দিন আকিকা কর ( তিরমিজি )। আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে, “৭ম দিন আকিকা করতে না পারলে যে কোন দিন করা যাবে। তবে কেউ যদি সপ্তম দিবসের প্রতি খেয়াল রেখে আকিকা করতে চায় তাহলে সে জন্মদিনের আগের দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার জন্মদিন হলে তার আগের দিন বুধবার আকিকা করলেও চলে ”এ ধারণার কোন ভিত্তি নেই। 
আকিকা অর্থ আল্লাহর দরবারে নজরানা পেশ করা, শুকরিয়া আদায় করা। আকিকা একটি ইবাদত। সন্তানের আগমনে খুশী হয়ে সেটি করা হয়। এর ফলে  বাচ্চা বন্ধকমুক্ত হয় এবং পিতামাতার সুপারিশ করার উপযুক্ত হয়। এটি জানের সদকাহ।  ইসলামি পরিভাষায় আকিকা হচ্ছে নবজাতকের পক্ষ থেকে পশু জবেহ করা। কোন কোন আলেম একে সুন্নাতে মোয়াক্কদা বলেছেন। সন্তান আগমনকে সব সময় সুসংবাদ হিসেবে দেখা হয়। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে “ অতঃপর ফেরেস্তারা তাকে ডেকে বলল  (সে যখন কক্ষে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করেছিল।) নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে ইয়াহ্ইয়া সম্পর্কে সুসংবাদ দিচ্ছেন (সূরা আল ইমরানঃ ৩৯)। অন্য এক আয়াতে আছে “ হে জাকারিয়া আমি তোমাকে একটি পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছি । তার নাম ইয়াহ্হিয়া। ইতিপূর্বে কাউকে আমি এ নাম দেইনি ( সুরা মরিয়ম-৭)। অতএব দেখা যায় সন্তান জন্মে খুশি হওয়া ,আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা, বড় সওয়াবের কাজ। 
আকিাকর পশু কী হবে এব্যপারে আমাদের সমাজে কিছু বিতর্ক রয়েছে। উম্মে কুরুজ আল কাবিয়া বলেন- আমি রাসূলুল্লাহ ( সাঃ ) কে আকিকা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি , তিনি বলেন - ছেলের পক্ষ থেকে ২টি আর মেয়ের পক্ষ থেকে ১টি পশু নর-মাদি যে কোন প্রকার হলেই চলে; এত কোন সমস্যা নেই  ( আবু দাউদ, নাসয়ি) । হযরত আয়েশা রাঃ পশু হিসেবে বকরী জবেহ করার কথা বলেছেন। ( আবু দাউদ)। আকিকার মাংস রান্না কওে পরিবারের লোকজন , বন্ধু- বান্ধব ও আত্মীয় স্বজন খেতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে উপঢৌকন পাবার আশায় গরীবদেরকে বাদ দিয়ে ধনী লোকদের দাওয়াত দিয়ে খাওয়ালে আকীকার ফায়দা হাসিল হবে না। কেননা ঐ ধরণের ভোজসভা নিকৃষ্ট যেখানে গরীবদেরকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। হযরত আয়েশা  (রাঃ) বর্ণনা করেন আকিকার মাংস নিজেরাও খাবে এবং সদকাহ ও করবে। এ পশুর চামড়ায় বিক্রয়লব্দ টাকা গরীব মিসকিনদের দান করে দেবে। আকিকার গোস্ত কাঁচা বা রান্না করে খাওয়ানো যায় ( বোখারী )। এ মাংস যার নামে আকিকা হচ্ছে সে নিজে  এবং তার পিতা-মাতাও খেতে পারবেন। আকিকা করার সময় সাদকাহ করা উত্তম। হযরত আনাস রাঃ হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাঃ ৭ম দিন হাসান ও হুসাইন এর চুল কাটার নির্দেশ দেন। এবং চুলের ওজন পরিমাণ রৌপ্য সদকা করেন। পিতা অসমর্থ হলে চাচা বা মামা অথবা অন্য কেউ আকিকা করতে পারেন। তবে ইয়াতিম সন্তানের আকিকা তার সম্পদ থেকে দেয়ার ব্যপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কেউ আকিকা দিতে অক্ষম হলে সে গোনাহগার হবে না। কেননা আল্লাহতায়ালা কারও সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দেননা।  (সূরা বাকারা- ২৮৬) 
আকিকার দ্বারা বিভিন্ন প্রকার বালা মুসিবত ও বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আকিার গুরুত্ব অনেক। সালমান  (রাঃ ) থেকে বর্ণিত রাসূল ( সাঃ ) বলেন- বাচ্চার সঙ্গে আকিকার দায়িত্ব রয়েছে। সুতরাং তার পক্ষ থেকে আকিকা কর এবং তার শরীর থেকে কষ্টদায়ক জিনিস দূর করে দাও। ( বুখারী )। সামুরা রাদিয়ল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত নবীজী বলেন- প্রত্যেক সন্তান তার আকিকার বিনিময়ে বন্ধক হিসেবে রক্ষিত। অতএব সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে আকিকা কর, তার চুল কাট ও নাম রাখ ( আহমদ, তিরমিজি )।
সন্তানের আকিকা দেয় একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। আমাদের সমাজে দেখা যায় আধুনিক পদ্ধতিতে সন্তান প্রসব করাতে গিয়ে বহু টাকা খরচ করা হয়। কিন্তু কয়েক হাজার টাকা খরচ করে আকিকা দেয়ার কথা অনেকেরই মনে থাকে না। এছাড়া কুরবানির সাথে শরীক হিসেবে আকিকা দেয়ার একটি সিস্টেম চালু আছে যা সহীহ হাদিসভিত্তিক নয়। হযরত মুহাম্মদ সাঃ কখনও কুরবানীর সাথে আকিকা দিয়েছেন এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। নবীজী নিজের আকিকা নিজে দিয়েছেন ( তাই সন্তান বড় হলে সে ও নিজেরটা দিতে পারবে )বলে যে রেওয়াজ চালু আছে তাও দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়। আমরা যেন সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নবীজীর তরীকা মোতাবেক আকিকা দিতে পারি; আল্লøাহ আমাদেরকে সে তৌফিক এনায়েত করুন। আমিন। 
লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা,   প্রভাষক , সাংবাদিক ও  ধর্মীয় গবেষক, কুমিল্লা।



No comments

Theme images by mammuth. Powered by Blogger.