কারবালার শিক্ষাঃ মুসলিম সমাজে একতা
কারবালার শিক্ষাঃ মুসলিম সমাজে একতা
মমিনুল ইসলাম মোল্লা,মুয়াবিয়া (রাঃ)এর মৃত্যুর পর তার ছেলে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া সিংহাসনে আরোহন করেন। হোসাইন (রাঃ) ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার হাতে বায়াত করেন নি। মুয়াবিয়া (রা) জীবতি থাকা কালীন সময়ে ক্ষমতার ব্যাপারে একটি চুক্তি হয়। এ চুক্তি মোতাবেক হযরত আলী (রা) এর ছেলে শাসক হওয়ার কথা। চুক্তিতে বলা হয় মুয়াবিয়া রা এর মৃত্যুর পর ক্ষমতা ঈমাম হাসান রা এর নিকট যাবে। (তারিখ আল খুলাফা,পৃ ১৯৪ এবং আল বিদায়া ওয়া আল নিহায়া পৃ৪১)।
আনাস (রাঃ) বলেন, হোসাইন (রাঃ) ছিলেন রাসুল (সাঃ) এর সাথে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ ( বোখারি) ।যখন হোসাইন ছোট ছিলেন, নবি (সাঃ) হাত বাড়িয়ে দিতেন এবং বলতেন ও হোসাইন ,আরোহন কর, আরোহন কর, তখন সে উপরে উঠতে থাকত , পা থেকে নবীর বুক পর্যন্ত এবং তখন তাদের চেহারা একে উপরের দিকে থাকত, নবী (সাঃ) গভীর ভালবাসা নিয়ে তাকে চুমু খেতেন এবং বলতেন, ও আল্লাহ আমি তাকে ভালবাসি তুমিও তাকে ভালবাস। তাই হাসান হোসাইনের ভালবাসা ও মহব্বত করা ইবাদতের অংশ । হোসাইন (রাঃ) মিথ্যার সাথে আপোস করেন নি। তাই আমরা প্রাণপনে সত্যকে আগলে রাখব। তিরমিযি শরিফে বর্নিত হয়েছে নবি (সাঃ) ঈমাম হাসান এবং হোসাইন কে নিয়ে বল্লেন, যারা আমাকে ভালবাসে এই দুই জন ও তাদের বাবা মায়ের সাথে , তারা আমার সাথে হাশরের ময়দানে থাকবে। নবিজীর বংশধরের প্রতি আমরা সব সময় কল্যাণকর দোয়া করব। আমরা তাদেরকে ভালবাসব। বোখারি শরিফে বর্ণিত হয়েছে, উসামা বিন যায়েদ বর্ণনা করেন নবি (সাঃ) হোসাইন এবং হাসান কে তোলে ঘোষণা করেন যথার্থই আমি তাদের ভালবাসি , তুমিও তাদের ভালবাস। এছাড়া তিরমিযি শরিফে বর্ণিত হয়েছে- নবি (সাঃ) আলি, ফাতিমা, হাসান, এবং হোসাইন কে বলেন, আমি বিরুদ্ধাচারী যারা তাদের বিরোধীতা করে এবং আমি শান্তিপূর্ণ তাদের সাথে যারা তোমাদের সাথে শান্তিপূর্ণ।
কুফাবাসী ঈমাম হোসাইন হোসাইনকে আমন্ত্রন জানিয়েছিল। পরবর্তীতে তাদের কথা ও কাজে গরমিল দেখ যায়। বর্তমানেও আমাদের মধ্যে ইমানী দুর্বলতা লক্ষ করা যায়। কথা দিয়ে কথা রক্ষা না করা খুবই অপছন্দনীয় কাজ। আল্লাহ বলেন, মুমিনগণ! তা কেন বল তোমরা যা কর না, এরুপ বলা আল্লাহর কাছে খুবই অপছন্দনীয় কাজ। ( সুরা আসসফ-২,৩) একজন মুসলমান বিপদে পড়লে বা কোন সমস্যার মুখোমুখী হলে অন্য মুসলমানদের উচিত তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া, ইয়াজিদের শাসনকালে কুফাবাসী বেশি সমস্যায় পড়েছিল। তাদের সাহায্যে এগিয়ে গিয়ে প্যাণ বিসর্জন দিয়েছিল হোসাইন বাহিনী। অথচ বর্তমানে আমাদের সামনে কোন মুসলমান, সমস্যায় পড়লে আমরা অনেক সময় তা এড়িয়ে যাই। মুসলমান হিসাবে কাম্য নয়। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অক্ষুণœ রাখা কারবালার শিক্ষা। হোসাইনের হোসাইনের বাহিনী অল্প হলেও তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট ছিল। রাসুল (সাঃ) বলেছেন একজন মুমিন আহলে ইমানদারদের ক্ষেত্রে তার অবস্থান হবে শরীরের মাথার মত। একজন মুমিন ইমানদারদের দুঃখে দুঃখিত হবে। যেমন মাথায় কিছু হলে সারা শরীরে অনুভব করে। ( আহমদ ৩৪০)গুনাহের কারণে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। এ কারণে ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্কের অবনতি ঘটে । আমাদের সমাজে বর্তমানে বহু ধরণের পাপ কাজ হচ্ছে। আমাদের মধ্যে থাকা সত্বেও আমরা এসব কাজের প্রতিবাদ করছিনা। হোসাইন হোসাইন মুসনাদে আহমদে বলা হয়েছে “ নবি করিম (সাঃ) বলেন, - যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে বা ইসলামের স্বার্থে তার অপর ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে তাহলে তা একমাত্র ছিন্ন হতে পারে না,যদি তাদের কেউ কোন গুনাহ করে ফেলে কেবল তাহলেই গুনাহের কারনে আজ পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন গোত্রে বিরোধ দেখা দিচ্ছে এবং রক্তপাত হচ্ছে। অথচ কোন মুসলমানের রক্ত অন্য কোন মুসলমানের জন্য হালাল নয়। বর্তমানে আমরা অনেকেই সম্পদের দিকে বেশি ঝুকে পড়ছি। দুনিয়ার মোহ আমাদেরকে আখিরাত বিমুখ করে তোলছে। আমাদের কোন মাল বা টাকা পয়সা ছোটে গেলে আমরা অনেক সময় মিথ্যার সাথে আপোষ করে ফেলি। অথচ ঈমাম হোসাইন এবং তার বাহিনীর লোকেরা ইমানি শক্তির বলে মদীনার সবকিছু ত্যাগ করে কুফার উদ্দ্যেশে রওনা হয়েছিল। ঈমাম হোসাইন প্রাণ দিলেন, কিন্তু সত্যের উন্নত শীরকে সমুন্নত করে গেলেন। সে শির এখনও নত হয়নি , কোন দিন হবে ও না। ইমানদার মুসলমানরা বীরের জাতি তারা বার বার রক্ত দিয়ে তার স্বাক্ষর রেখেছে।
লেখকঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক , সাংবাদিক ও ধর্মীয় গবেষক, কুমিল্লা। ০১৭১১৭১৩২৫৭ সধসরহসড়ষষধয@ুধযড়ড়.পড়স
৬০০ ওয়ার্ডের অতিরিক্ত
ঈমাম হাসান জনগণ র্কতৃক বায়াতকৃত খলিফা ছিলেন। তাই হোসাইনের খলিফা হওয়ার ব্যাপারটি চুক্তিতে স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে ইয়াজিদের খলিফা পদে আসিন হওয়া একদিকে ছিল স্বীকৃত চুক্তির খেলাফ। কুফার কিছু কিছু লোক হোসাইন রা এর পক্ষে ছিলেন। তারা আমির হিসেবে হোসাইন (রাঃ) কে চাচ্ছিলেন । এ ব্যাপারে কুফা থেকে বহু চিঠি আসতে থাকে। ঈমাম হোসাইন মনে করেন ইয়াজিদের হাতে বায়াতকরা অন্যায়। ইসলামি আদর্শে ভুলুন্ঠিত হওয়কে তিনি বরদাশত করতে পারলেন না। তাই মদিনায় অলসভাবে বসে থাকাকে তিনি সমিচীন বলে মনে করলেন না। কম শক্তি নিয়েই এগিয়ে গেলেন।ঐতিহাসিক আবু মিকনাফ (মৃত্যু ১৫৭ হিজরি) তার “কিতাব মাকতালা আল হোসাইন” গ্রন্থে সর্ব প্রথম নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে এ ঘটনার প্রতক্ষ্যদর্শীদের বর্ণনা সংগ্রহ করে বিবরন লিপিবদ্ধ করেন।কুফার প্রকৃত অবস্থা যাচাইয়ের জন্য হোসাইন (রাঃ) এর চাচাত ভাই মুসলিম বিন আকিলকে পাঠান। মুসলিম কুফায় যান সেখানে গিয়ে ঈমাম হোসাইনের পক্ষে বায়াত নেন। হানি বিন উরওয়ার ঘরে এ বায়াত সম্পন্ন হয় । আবু সাঈদ আল খুদুরী বলেন রাসুল (সাঃ) বলেন হাসান এবং হোসাইন জান্নাতের যুবকদের নেতা। ঈমাম হোসাইন ছিলেন আলী রা এর পুত্র এবং রাসুল (সাঃ) এর কন্যা ফাতেমা রা এর দ্বিতীয় পুত্র। রাসুল (সাঃ) এর নাতি হওয়ায় তিনি ছিলেন আহলে বাইতের অর্ন্তভুক্ত।
হোসাইন( রাঃ ) কুফা অভিমুখে রওয়ানা হচ্ছে ইয়াজিদের নিকট এ খবর পৌঁছলে বসরার গভর্ণর উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদকে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য পাঠান। ইয়াজিদ এর পক্ষে নেতৃত্ব দেন উবয়াদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ , উমর ইবনে সাদ, সীমার ইবনে হিলে জশান । অন্য দিকে হোসাইন এর বাহিনীতে হোসাইন ইবনে আলী, আল আব্বাস ইবনে আলী, হাবিব ইবনে মুজাহির, । উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে হোসাইনের সৈন্য সংখ্যা ছিল ৭০-১৫০ জন।মুসলিম বিন আকিল চার হাজার সমর্থক যোগাড় করলেন। কিন্তু ইয়াজিদের ভয়ে এক সময় সবাই সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। তাই ঈমাম হোসাইন কে মদিনায় ফেরৎ যাওয়ার জন্য চিঠি লিখেন ( মিনহাজুস সুন্নাহ)। ইবনে তাইমিয়ার মতে চিঠিটির ভাষা ছিল এরকম “ হোসাইন পরিবার নিয়ে ফেরৎ যাও। কুফাবাসীদের ধোকায় পড়োনা। কেননা তারা তোমার সাথে মিথ্যা বলেেেছ। আমার সাথেও তারা সত্য বলেনি। আমার দেয়া এই তথ্য মিথ্যা নয়।” জিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখে চিঠি লেখক মুসলিমকে হত্যা করা হয়। এ চিঠি পাওয়ার আগেই ৮ জিলহজ্ব মক্কা থেকে হোসাইন (রাঃ) কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন। মুসলিমের চিঠি পেয়ে হোসাইন (রাঃ) কুফায় না গিয়ে ইয়াজিদের সাথে দেখা করার জন্য সিরিয়া যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন। পথে কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনী গতি রোধ করে। গতিরুদ্ধ হওয়ার পর ইয়াজিদ বাহিনীর কাছে ৩টি প্রস্তাব দেয়া হয়। ১. হোসাইন (রাঃ) কে ইয়াজিদের দরবারে যেতে দেয়া হোক। ২. তাকে মদীনায় ফেরৎ যেতে দেয়া হোক। ৩. তাকে অন্য কোন মুসলিম অঞ্চলে যেতে দেয়া হোক। ওবায়দুল্লাহর বাহিনী এ প্রস্তাবের কোনটিতেই রাজী হন নি। ওবায়দুল্লাহর নেতৃত্বে কারবালায় হোসাইন বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয়। একে একে সবাই শাহাদত বরণ করলেন। শেষে সীমার বিন যুলজাওশান এর বর্শার আঘাতে ঈমাম হোসাইন শহীদ হন।
০৮.১০.১৬
No comments