সাংবাদিক হত্যা ও বাকস্বাধীনতার মৃত্যু
মমিনুল ইসলাম মোল্লা, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।
গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার এক চা-দোকানে বসা অবস্থায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয় স্থানীয় সাংবাদিক মো. আসাদুজ্জামান তুহিনকে। ৩৮ বছর বয়সী এই সাংবাদিক ছিলেন দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর গাজীপুর স্টাফ রিপোর্টার এবং স্থানীয়ভাবে পরিচিত একজন সংবাদকর্মী। ঘটনাটি ঘটেছে রাত সাড়ে আটটার দিকে, শহরের ব্যস্ত এলাকায়, যা মুহূর্তেই সিসিটিভি ও প্রত্যক্ষদর্শীর মোবাইল ভিডিওর মাধ্যমে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রথম আলো, বাংলাদেশ প্রতিদিন, কালের কণ্ঠ, যুগান্তর এবং ইত্তেফাক—সবগুলো প্রধান জাতীয় দৈনিকই এই হত্যাকাণ্ডকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, হত্যাকারীরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে অতর্কিতে হামলা চালায় এবং পালিয়ে যায়। তুহিনকে দ্রুত স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হলেও চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে হত্যার মোটিভ নিয়ে নানামুখী তথ্য পেলেও এখনো নিশ্চিত কোনো কারণ জানায়নি।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদনে নিহতের সহকর্মীদের শোক ও ক্ষোভ, এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। প্রথম আলো ঘটনার বর্ণনা ও আটককৃত সন্দেহভাজনদের তথ্য প্রকাশ করেছে। কালের কণ্ঠ শহরের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও একই সময়ে অন্য এক সংবাদকর্মীর ওপর হামলার প্রসঙ্গ এনে সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন তুলেছে। যুগান্তর প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান ও মামলার অগ্রগতি তুলে ধরে “কেন নিহত হলেন তুহিন”—এই প্রশ্নটি সামনে এনেছে। ইত্তেফাক পুলিশের দ্রুত অভিযান, পাঁচজন আটক এবং ঢাকায় সাংবাদিক সমাজের মানববন্ধনসহ ন্যায়বিচারের দাবির কথা উল্লেখ করেছে।
ঘটনার পর সাংবাদিক সংগঠনগুলো নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে দোষীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানায়। মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা ও বিবৃতিতে বলা হয়—এটি শুধু একজন সাংবাদিককে হত্যা নয়, বরং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর একটি গুরুতর আঘাত।
এ হত্যাকাণ্ড নতুন করে সামনে এনেছে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা সংকটের বিষয়টি। মাঠপর্যায়ে কাজ করা সাংবাদিকরা প্রায়ই স্থানীয় ক্ষমতাবান বা অপরাধচক্রের হুমকি ও ঝুঁকির মুখে থাকেন। তুহিন হত্যার মতো প্রকাশ্য ঘটনা প্রমাণ করে, শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি নয়, কার্যকর সুরক্ষা ব্যবস্থা ও দ্রুত বিচারের নিশ্চয়তা এখন জরুরি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে, ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও জড়িতদের শনাক্তে সিসিটিভি ফুটেজ ও গোয়েন্দা তথ্য ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে সাংবাদিক সমাজ মনে করছে, অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে—যদি মামলার অগ্রগতি ধীর হয় বা তদন্তে গাফিলতি হয়, তাহলে অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে, যা ভবিষ্যতে আরো ঝুঁকি ডেকে আনবে।
গাজীপুরের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড কেবল স্থানীয় কোনো ঘটনা নয়; এটি দেশের গণমাধ্যম, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও নাগরিক নিরাপত্তার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। তুহিনের সহকর্মীরা যেমন বলেছেন, “আমরা কাগজে কলমে শুধু নয়, মাঠে থেকে সত্য বলি—এ জন্যই যেন আমাদের জীবন দিতে হয়।” এই বেদনাদায়ক বাস্তবতা বদলাতে হলে রাষ্ট্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সমাজ—সব পক্ষকেই কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে, যাতে আর কোনো সাংবাদিককে এমন পরিণতি বরণ করতে না হয়।
লেখক পরিচিতি: মমিনুল ইসলাম মোল্লা সাংবাদিক , কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী কুমিল্লা।।
No comments