কন্যা শিশুরাও জাতির ভাবষ্যৎ
মমিনুল ইসলাম মোল্লা 

বাংলাদেশের শিশুদের অর্ধেকই কন্যা শিশু । তাদেরকে কুসুমিত হওয়ার সুযোগ না দিলে জাতি হিসেবে আমাদেরকে এর খেসারত দিতে হবে। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের কন্যা সন্তানরা অবহেলিত হচ্ছে। তারা মনে করেন পুত্র সন্তান তাদের জন্য সহায়ক। তাই তারা কন্যা সন্তানের প্রতি উৎসাহী নন। বাংলাদেশে মুসলমান, হিন্দু,  বৌদ্ধ ও খৃষ্টান ধর্মের লোক বসবাস করে। এসব ধর্মে নারীর চেয়ে পুরুষকে বেশী প্রাধান্য দেয়া  হয়েছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত কিছু কিছু উপজাতিতে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ লক্ষ্য করা যায় । পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর তেমন স্বাধীনতা থাকেনা। পুরুষের নির্দেশ অনুসরণ করাই তাদের কাজ। তাই এখানে ছেলে সন্তানের কদর বেশী। আমরা আমাদের বংশ রক্ষা করতে চাই। ছেলে সন্তানের মাধ্যমেই বংশ রক্ষা করা সহজ। কন্যা সন্তানের মাধ্যমে তা হয়তো সেভাবে রক্ষা হয়না। তাই সবাই চায় পুত্র সন্তান। ফলে কন্যা সন্তানগন অবহেলিত হচ্ছে। ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে জাতীয় কন্যা শিশু দিবস পালিত হয়। কন্যা শিশুদের প্রতি অবহেলা রোধ এবং যথাযথভাবে তাদের বেড়ে উঠার সুযোগ দানে সহায়তা করাই এ দিবস পালনের লক্ষ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য কন্যা দিবসে কন্যাদের ব্যাপারে বহু কথা বলা হয় , কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ চেতনা ধীরে ধীরে কমে যায়। এ ব্যাপারে সরকার উদার নীতি গ্রহণ করলেও পারিবারিকভাবে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছেনা।
 এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি কাজে পুত্র সন্তানই পিতার সহায়ক। তাই পুত্র সন্তানের চাহিদা বেশী। কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তাদের আশা ভঙ্গ হয়। এধরণের পরিবারে কন্যা সন্তান জন্ম দেয়া পাপের শামিল। মনে হয় মা যেন মহাপাপ করেছেন। কন্যা শিশুটি বোধ হয় সকলের জন্য কোন অশুভ বার্তা নিয়ে এসেছে। তাই সন্তান জন্মাবার পরপরই দাদা-দাদি, বাবা-কাকা , খালা –ফুফুদের মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। মায়ের সাথে কেউ হাসি মুখে কথা বলেননা। পরিস্থিিিত আঁচ করতে পেরেমাও কেঁদে ফেলেন। তাদের ধারণা বৃদ্ধ বয়সে মা বাবাকে ছেলেরাই দেখে। কারণ তারা চাকুরি অথবা ব্যাবসা-বাণিজ্য করে অর্থ  উপার্জণ করে পিতার ভিটিতে অবস্থান করে বৃদ্ধ মা-   –বাবার সেবা শুশ্রষা করবে।  তাদের চিন্তা একেবারে অমূলক নয়। মানুষের জীবনে এমন একটি সময় আসে যখন সন্তানের উপর তাকে নিভর্রশীল হতে হয়। কিন্তু আপনার ছেলেই যে আপনার বিপদের দিনের সাথী হবে এমন গ্যারান্টি কে দিবে অল্লাহ যেহেতু নারী জাতিকে অবহেলা করেননি আমরা তার বান্দা হয়ে নাফরমানি কাজ করতে যাব কেন? পবিত্র কুরআন শরীফে ১১৪টি সুরা আছে। পুরুষদের জন্য আলাদা কোন সুরা নেই। কিন্তু নারীদের ব্যাপারে একটি আলাদা সুরা আছে, সেটি হচ্ছে সুরা নিসা।  তিনি বলেছেন-তোমরা নারীদের পোশাক স্বরুপ , নারীরাও তোমাদের পোশাক স্বরুপ। কন্যা সন্তানের ব্যাপারে বলা হয়েছে    - –যমিন ও আসমানের বাদশাহীর অধিকর্তা আল্লাহ। তিনি যা ইচছা সৃষ্টি করেন। যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন। আর যাকে ইচ্ছা কন্যা  ও পুত্র উভয়টিই দেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধা করে দেন।” এছাড়া সম্পত্তির ব্যাপারে সুরা নিসায় বলেন-তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে.আল্লাহ এই বিধান দিচ্ছেন যে -একজন পুত্রের অংশ দুজন কন্যার সমান হবে। যদি কন্যার সংখ্যা দুয়ের অধিক হয় তবে তারা পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ পাবে , আর যদি মাত্র একটি কন্যা সন্তান থাকে তাহলে সে অর্ধেক পাবে ----মৃতের রিণ পরিশোধ ও অছিয়ত পূরণ করার পরে।” তবে ইসলাম নারীকে মর্যাদা কম না দিলেও কন্যা ও ছেলে সন্তানের মধ্যে পার্থক্য বজায় রেখেছে ।  দুজ নকে  সমান দায়িত্ব ও কর্তব্য দেয়া হয়নি। মূলত সংসার চালানো ও নির্ভরশীলদের ব্যাপারে কর্তা ব্যক্তিকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।  ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী সন্তান জন্ম গ্রহণের পর তার আকিকা করতে হয়। তৎকালীন সময়ে ইহুদীরা কন্যা সন্তানের জন্য কোন আকিকা করতোনা। এব্যাপারেনবীজীকে (সাঃ) সাহাবারা জিজ্ঞেস করলে তিনি তাদের ছেলে হলে সমবয়সী দুটি ছাগল ও মেয়ে হলে একটি ছাগল দিয়ে আকিকা করতে নির্দেশ দেন। রাসুল সাঃ হাসান (রাঃ) ও হুসাইন (রাঃ) এর জন্য দুটি করে ভেড়া দিয়ে আকিকা করেন। জন্মের ৭ম দিনে তা করে মাথা  ন্যাড়া করেন। একথা সত্যি যে বাংলাদেশের বর্তমান পরিবেশ -পরিস্থিতি অনুযায়ী পুত্র সন্তানের চেয়ে কন্যা সন্তান লালন-পালন ,সঠিকভাবে শিক্ষিত করে সৎপাত্রে দান করা কষ্টকর। কিন্তু ছেলে সন্তান হলে এগুলো নিয়ে তেমন একটা ভাবতে হয় না। তবে এপরিস্থিতির জন্যতো আর কন্যা সন্তানগন দায়ী নয়। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছেন –-” এসেছে নতুন শিশু তাকে ছেড়ে দেতে হবে স্থান ----নবজাতকের জন্য এ পৃথিবী বাসযোগ্য করে যাব এই হোক মোর অঙ্গীকার।” বাংলাদেশ সংবিধানের ১০ নং ধারায় বলা হয়েছে-” জাতীয় জীবনের সর্বস্তওে মহিলাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
বাংলাদেশে মুসলমানদের পর পরই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের স্থান।এ ধর্মেও কন্যা সন্তনের চেয়ে পুত্র সন্তানকে বেশী প্রধান্য দেয়া হয়েছে। তাদের উত্তরাধিকার আইন হিন্দু আইন নামে পরিচিত। এটি তাদের ধমীয় ও ব্যক্তিগত অইন। যারা জন্মসূত্রে হিন্দু তাদের জন্য এ আইন প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে” দায়ভাগ ”ও অন্যত্র” মিতক্ষরা” পদ্ধতি চালু রয়েছে। যে ব্যক্তি পিন্ড গ্রহণ করে এবং যে ব্যক্তি পিন্ড দানে অংশগ্রহণ করে তারা মৃতের সম্পত্তির উদত্তরাধীকারী হয়। সে ক্ষেত্রে কার ও  যদি এক কন্যা থাকে সে কন্যার যদি পুত্র থাকে তাহলে সে নানার সম্পত্তি পাবে । অর্থাৎ স্ত্রী /কন্যা সম্পত্তি ভোগ করতে পারবে কিন্তু এগুলোর মালিক বা হস্তান্তর করতে পারবেনা। তাই বংশ রক্ষার জন্য হিন্দুরাও পুত্র সন্তান প্রত্যাশা করে।
রাষ্ট্রীয় ভাবে কন্যা সন্তানদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা হলেও পারিবারিক অবহেলার কারণেই তারা এগুতে পারছেনা। যখন পিতা বুঝতে পারেন তাদের অতিথি মেয়ে তখন থেকেই অবহেলা শুরু হয়। তবে প্রথম সন্তান যদি ছেলে হয় দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে হলে হয়তো কেউ আপত্তি করেনা। কিন্তু প্রথম সন্তান যদি মেয়ে হয় অথবা মেয়ে যদি ধারাবাহিকভাবে চলতেই থাকে তাহলে মেয়েরা অধিক অবহেলার শিকার হয়। কোন কোন পরিবারে দেখা যায় ছেলে শিশুর জন্য মায়ের দুধের পাশাপাশি বিকল্প খাবার হিসেবে উন্নত মানের দুধ বা ভিটামিন জাতীয় খাবার দেয়া হয়। কিন্তু কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে রহস্যজনক নিরবতা লক্ষ করা যায়। ”কোনরকমে বেঁচে থাকলেই হলো ”এমন একটি ভাব তাদের মধ্যে বিরাজ করে।শিক্ষা ক্ষেত্রেও দেখা যায় বৈষম্য । ছেলেটাকে কোন স্কুলে পড়াবে ? ইঞ্জিনিয়ারিং না মেডিকেল বর্ণমালা শিখার আগেই এ চিন্তা তাদের মাথায় আসে। কিন্তু মেয়ের ক্ষেত্রে এধরণের তৎপরতা লক্ষ করা যায় না।শুধু খাদ্য আর শিক্ষাই নয় বস্ত্র , অবসর  , বিনোদন প্রতিটি ক্ষেত্রেই বৈষম্য লক্ষ করা যায়। এ বৈষম্য কোন কোন সময় নির্যাতনে পরিনত হয়। পারিবারিকভাবেই নয় সামাাজিক ভাবেও কন্যা শিশুরা নির্যাতিত হচ্ছে। কন্যা সন্তানের প্রতি যতœ না নিলে আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার । কেননা দেশের মোট জনগোষ্ঠির অর্ধেক নারী। আমরা হাত দিয়ে কাজ করি। এক হাত দিয়ে কোন রকমে কাজ চল্লেও   দুহাতের সমান কাজ করা যায় না। তাই দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে অবহেলা  , বৈষম্য , আরা নির্যাতনের মধ্যে রেখে জাতীয় উন্নয়ন কখনও সম্ভব নয়। এজন্য কন্যা শিশুর বিকাশে যে সমস্ত সমস্যা রয়েছে সেগুলো চিহ্ণিত করে তা দূর করতে হবে।”ছেলে -মেয়ে সমানে সমান ”এই হোক এবারের কন্যা শিশু দিবসের অঙ্গীকার। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান । ইসলাম ধর্মে মা বাবার প্রতি দায়িত্ত পালনের জন্য সন্তানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে -তোমাদেরকে শৈশবে তারা যেভাবে লালন পালন করেছেন তোমরাও তাদের প্রতি তেমনি সদয় হও। তাদের সাথে এমন ব্যবহার করোনা যাতে তারা বিরক্ত হয়ে উহঃ শব্দটি উচ্চারণ করে। তাহলে দেখা যায় মা বাবাকে দেখার দায়িত্ব শুধুমাত্র ছেলেদেন নয় মেয়েদেরও সমান দায়িত্ব রয়েছে। তাই ছেলেটি আপন মেয়েটি পর, এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। কেউ কেউ মনে করেন মেয়েরা হচ্ছে সংসারের অতিথি। দুদিন পর সে চলে যাবে । তাই তার প্রতি অতিরিক্ত যতœ নেয়ার প্রয়োজন নেই। কথাটির হয়তো ভিত্তি আছে। পুরূষ শাসিত সমাজে বিয়ের পর মেয়েদেরকেস্বামীর সংসারে চলে যেতে হয়। এটাই স্বাভাবিক। কারণ পুরুষশাসিত সমাজে   মেয়েরা পরনির্ভরশীল। তাদের জীবনের সুখ শান্তি ৩ টি পর্যায়ে বিভক্ত । প্রথমত ঃপিতার মর্জির উপর তাকে চলতে হয়। বিয়ের পর স্বামীর ইচ্ছার কাছে তাকে সপে দিতে হয়। তৃতীয়তঃ বৃদ্ধ বয়সে সে সম্পুর্ণভাবে ছেলের  উপর নির্ভরশীল। ৩টি পর্যায়ে সুখ -শান্তি পাওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। মূলত ভাগ্যেরউপর আমাদের কোন হাত নেই। এব্যাপারে আমাদের সৃষ্টিকর্তাই ভাল জানেন। তাই তার উপর তোয়াক্কাল রাখা উচিত।
 লখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা, প্রভাষক, সাংবাদিক ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের ক্যাম্পেনার