হিজড়াদেরকে অর্থনীতির মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে 

মমিনুল ইসলাম মোল্লা,সাংবাদিক,কলামিস্ট,কুমিল্লা।।

প্রাচীনকাল থেকেই সারা বিশ্বে লিঙ্গ প্রতিবন্ধী এক শ্রেণির মানুষ দেখা যায়। তারা স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় ব্যাতিক্রম। তাদেরকে কেউ বলে খোজা আবার কেউ বলে হিজড়া। কোন বাড়িতে বাচ্চা প্রসব করলে সেখানে তারা ছুটে যায়।
  এসে বলে উঠে দে নারে তোর মনিটারে একটু নাচাই। আমাদেরে দেশেও হিজড়া সম্প্রদায়ের  লোকের সংখ্যা কম নয়। তাদের সামাজিক পদমর্যাদার অবস্থা শোচনীয় । হিজড়া হয়ে কোন শিশু জন্ম গ্রহণ করলে সংশ্লিষ্ট পরিবারটি ঐশিশুটিকে সঙ্গে রাখতে চান না। একসময় ঐ শিশুটি হিজড়াদের দলে যোগ দেয়। তাদের জীবন ও জীবিকার পদ্ধতি ভিন্ন হওয়ায় তারা সামাজিকভাবে নিগ্রহের শিকার হন। হিজড়া শব্দটি এসেছে আরবী হিজরত বা হিজরী শব্দ থেকে। যার আভিধানিক অর্থ পরিবর্তন , মাইগ্রেট বা ট্রান্সফার। এর ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশর লোকজন  বিশেষ এক ধরণের শারীরিক প্রতিবন্ধীদের হিজড়া বলে। মূলত লিঙ্গগত ত্রæটির কারণেই এদের সৃষ্টি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী এক্স এক্স প্যাপটার্নের ডিম্বানুর সমন্বয়ে কন্যা শিশু আর এক্স ওয়াই প্যাটার্ন থেকে সৃষ্টি হয় ছেলে শিশু। ভ্রæণের পূর্ণতার স্তরগুলোতে ক্রমোজম প্যাটার্নের প্রভাব পেলে ছেলে শিশুর মধ্যে অন্ডকোষ আর কন্যা শিশুর মধ্যে ডিম্বকোষ জন্ম নেয়। অন্ডকোষ থেকে নিসৃত হয় পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন এবং ডিম্ব কোষ থেকে নিঃসৃত হয় এস্ট্রোজেন। ভ্রæণের বিকাশকালে নিষিক্তকরণ ও বিভাজনের ফলে বেশ কিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সৃষ্টি হয় যেমন এক্স এক্স ওয়াই অথবা এক্স ওয়াই ওয়াই এর ফলে বিভিন্ন গঠনের হিজড়া শিশুর জন্ম হয়। শারীরিক ও মানুসিক গঠনের উপর নির্ভর করে এদেরকে কয়েকভাগে ভাগ করা যায়। শারীরিকবাবে পুরুষ কিন্তু মানসিকভাবে নারী বৈশিষ্ট্যর অধিকারী হিজড়াদের বলা হয় অকুয়া, অন্য হিজড়াদের বলা হয় জেনানা, তাদের কারোই পূর্নাঙ্গ পুরুষাঙ্গ বা স্ত্রী লিঙ্গ নেই। কেউ কেউ আবার  লিঙ্গগতবাবে পুরুষ ও নারী উভয়ের বৈশিষ্ট বহন করছে।  আর মানুষের হাতে সৃষ্ট বা ক্যাসট্রেড পুরুষদের বলা হয় চিন্নি। কিছু কিছু ক্লিনিকে নতুনভাবে হিজড়া তৈরি করা হয়। ফলে দেশে ক্যাস্ট্রেড হিজড়ার সংখ্যা বাড়ছে। অনেকের ¯ী¿ সন্তান থাকা সত্বেও স্বেচ্ছায় এ পথে আসে। কেউ কেউ মনে করেন এ পথে জীবিকা উপার্জণ করা সহজ। তার গুরুতর অপরাধ করেও বিভিন্ন উপায়ে ছাড়া পেয়ে যায়। এছাড়া হিজাড়াদের একটি গ্রæপ তাদের সদস্য বৃদ্ধির কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তারা সরল সুন্দর সপ্তম-অষ্টম শ্রেণির বারো-তেরো বছরের ছেলেদের ফুসলিয়ে প্রতারণায় ফেলে নিয়ে যায়। তারপর হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ডাক্তারের মাধ্যমে অপারেশন করে পুরুষাঙ্গ কেটে, ওষুধ খাইয়ে আকৃতি বিকৃতি করে , ইনজেকশন দিয়ে বা অপারেশন করে স্তন বড় করে এদরেকে হিজড়াদের খাতায় নাম লিখায়। 

হিজড়ারা দল বেঁধে চলাচল করে। তারা তাদের গুরুকে শ্রদ্ধা করে। চাঁদা তুলে যে অর্থ আদায় করে তা তারা তাদের গুরুর কাছে জমা রাখে। গুরুই খাওয়া ও প্রসাধনীর ব্যবস্থ্ াকরে দেয়। দলে আসার পর তারা পিতা-মাতা বা  ভ াই বোন কারো সাথে যোগাযোগ রাখে না। নতুনদেরকে গুরু শাড়ি পড়িয়ে আশির্বাদ স্বরুপ কপালে আাঁচল ছুঁয়ে এবং মন্ত্র পড়ে ফুঁক দেয়। বাংলাদেশ মানবাধিকার সূত্রে জানা যায় সারাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। এদরে মধ্যে কৃত্রিম হিজড়ার সংখ্যা ২০ হাজার। হিজড়ারা বিভিন্ন রকম অপরাধের সাথে জড়িত। এর মধ্যে চাঁদাবাঁজি , মাদক ব্যবস্যা, পতিতাবৃত্তির মতো জঘন্য অপরাধের জড়িত। জাতিসংঘের মানবাধিকার এর সার্বজনীন ঘোষণায় দাসত্ব থেকে মুক্তির অধিকার, ভোটাধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, স্বাধীনভাবে কাজের অধিকার, মানসম্মত জীবন- যাপনের অধিকার, আইনের আশ্রয় ও নির্যাতন থেকে মুক্তির অধিকার এবং বিবাহ ও পরিবার গঠনের অধিকার মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকায় ৫টি হিজড়া দল রয়েছে। তাদের রয়েছে নির্দিষ্ট এলাকা। এগুলো হচ্ছে ক. শ্যামপুর, ডেমড়া, ফতুল্লা খ. শ্যামলী মোহাম্মদপুর, মিরপুর গ. সাভার, ধামরাই ঘ. নয়াবাজার, কোতোয়ালি ঙ. পুরোনো ঢাকা, । নেতৃস্থানীয় গুরুগণ হচ্ছেন লায়লা, হামিদা, মনু সাধু ও দিপালী। যৌনসত্তা মানুষের স্বাভাবিক তাড়না। কিন্তু হিজড়াদের বিবাহের বিধান না থাকায় তারা যৌন সংক্রান্ত অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের স্বাভাবিক বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা নেই বলে স্বাভাবিক মানুষের সাথে তাদের বিয়ে স্বিকৃত নয়। ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ৩৭৭ নং দারায় হিজড়াদের যৌনতাকে “ সডোমী ” অর্থাৎ অস্বাভাবিক ও অনৈতিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং একে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে হিজড়াদের মধ্যে বিয়ের কোন বিধান নেই। এখানে বিভিন্ন ধরণের হিজড়া থাকলেও তারা দলে আসার পর হিন্দু ধর্মীয় বিধান মেনে চলে। তারা বিয়ের ক্ষেত্রে একধরণের পুজা করে। এর মাধ্যমে তারা ভগবানের সাথে নিজেদের বিয়ের কাজ সম্পাদন করে। তারপর সারাদিন সংসার সংসার খেলে। সন্ধ্যা হলে তারা বিধবা হয়ে শাদা শাড়ি পড়ে। পুরো বিধবা বেশভূষা  গ্রহণ করে স্বামীর মৃত্যু শোক করে। তখন তারা অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। 
হিজড়াদের সামাজিক মর্যাদা নেই। তাদেরকে পরিবার থেকে বের করে দেয়া হয়। তারা স্কুল-কলেজে নির্বিঘেœ লেখাপড়া করতে পারে না।   সরকারি চাকুরি করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাদের ভাষায় নারী আর পুরুষের মত আমরা নই, কোথা কবে রই/ঘর জন ছেড়ে ঘুরি পথ পানে, খুঁজে ফিরি জীবনের মানে।” বিশেষজ্ঞদের মতে সামাজিক স্বীকৃতি পেলে তার সুস্থ ধারায় ফিরে আসবে। তাদের রয়েছে পরিশ্রমের ক্ষমতা, যার সদ্ব্যবহার করে তারাও দেশের অথৃনীতিতে অবদান রাখতে পারে। এজন্য চিকিৎসার আওতায় এনে তাদেরকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে নারী/পুরুষে পরিনত করতে হবে। ভারতের অমলা পূর্ণ বয়সেও অপারেশনের মাধ্যমে পূর্ণ নারীতে পরিনত হওয়ার রেকর্ড রয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, বৈধব্য , মাতৃত্বহীনতা, বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরুপ অন্যান্য পরিস্থিতি জনিত অসুবিধায় তাদেরকে সাহায্য করতে হবে। ভোটার তালিকায় নিবন্ধিত করতে তাদেরকে উৎসাহিত করতে হবে। যেসব হিজড়াদের মধ্যে পুরুষালী ভাব স্পষ্ট তাদেরেকে পুরুষে এবং যেসব হিজড়ার মধ্যে নারীসুলভ ভাব স্পষ্ট তাদেরকে সরকারি খরচে নারীতে পরিনত করার ব্যপারে উদ্যোগ নিতে হবে। তারা যাতে তাদের পিতা মাতার সম্পত্তিতে সহজে অংশিদার হতে পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে।  ২০১৩ সালে হিজড়া সম্প্রদায়ের সংগঠন বাংলাদেশ হিজড়া কল্যান ফাউন্ডেশন ৮ দফা দাবী পেশ করে। এসব দাবীর মধ্যে শিক্ষা, চিকিৎসা, সামাজিক ও নাগরিক অধিকার অন্যতম। এছাড়া তারা সংসদে আসন সংরক্ষণ ও সরকারি চাকুরিতে বিশেষ কোটা দাবী করে। ১৪ এপ্রিল ২০১৪ বারতের সুপ্রীম কোর্ট হিজড়া বা কিন্নর গোষ্ঠীর মানুষদের পুরুষ ও মহিলার বাইরে একটি তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সে সঙ্গে সেদেশের কেন্দ্রীয় ও সকল অঙ্গ রাজ্য সরকারকে তৃতীয় লিঙ্গভ’ক্তদের সরকারি চাকুরিতে বিশেষ সুবিধা বা ভোটার কার্ড ও পাসপোর্টের ব্যবস্থা করার ও নির্দেশ দেয়। শুধু সুযোগ-সুবিধা নয় তাদের জন্য বিশেষ কোটার ব্যবস্থা করতে হবে। ভারতের দিল্লী হাইকোর্ট ২ জুলাই ২০০৯ সমকামীতাকে বৈধ ঘোষণা করে। ফলে হিজড়ারা নিজেদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বৈধতা পায়। আমাদের দেশে ইসলামী মূল্যবোধ থাকায় সেটি সম্ভব নয়। বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশের হিজড়াদের  তৃতীয় লিঙ্গের মর্যাদা দেয়। এর আগে ২০০৮ সালে সরকার তাদেরকে ভোটার তালিকায় প্রথম বারের মতো নাম অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ দেয়। তথাকথিত হিজড়া প্রজনন কেন্দ্র বন্ধ এবং কারিগড় ডিগ্রিধারী সার্জনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা গেলে হিজড়া উৎপাদন বšধ হবে। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠা হিজড়াদের সামজিকভাবে আড়চোখে না দেখে তাদেরকে আমাদের সমাজের একজন সদস্য হিসেবে ভাবতে হবে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয়ের আওতাধীন তাদেকে কারিগড়ি প্রশিক্ষণ ও অসহায় হিজড়াদেও জন্য ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে। 
লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের  প্রভাষক ও সাংবাদিক, কুমিল্লা।