দেবীদ্বারে ১২ শহীদের আত্মত্যাগ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাস//

 দেবীদ্বারে ১২ শহীদের আত্মত্যাগ: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাস//

✍️ মমিনুল ইসলাম মোল্লা, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক


দেবীদ্বার—কুমিল্লার এক শান্ত শহর, যা ২০২৪ সালের ৪ ও ৫ আগস্ট পরিণত হয় এক রণক্ষেত্রে। কেন্দ্রীয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর অংশ হিসেবে এ সময় দেবীদ্বারে ঘটে যায় এক বিভীষিকাময় অধ্যায়। আওয়ামী লীগের সশস্ত্র কর্মী ও পুলিশের যৌথ হামলায় শহীদ হন মোট ১২ জন, আহত হন অর্ধশতাধিক। ইতিহাসের পাতায় এই ঘটনা রক্তাক্ত এক অধ্যায় হয়ে জায়গা করে নিয়েছে।


চারপাশে যখন ছাত্র-জনতা বৈষম্য, অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর, তখন দেবীদ্বারের রাজপথে গর্জে ওঠে গুলি।

৪ আগস্ট বানিয়াপাড়ায় শহীদ হন পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুর রাজ্জাক বাদশা রুবেল (৪৩)। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও তাঁকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সে সময় তাঁর স্ত্রী ছিলেন ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।

৫ আগস্ট শহীদ হন স্কুলছাত্র আমিনুল ইসলাম সাব্বির (১৮)—যিনি ভ্যান চালিয়ে পরিবার চালাতেন। ৪০ দিন মৃত্যুর সাথে লড়ে ১৪ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

একই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন আব্দুস সামাদ, যিনি দীর্ঘ চিকিৎসার পর ৪ মার্চ মৃত্যু বরণ করেন।

আরও মর্মান্তিক হচ্ছে, আহত স্কুলছাত্র আবুবকর এখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন।


এ তিনজন ছাড়াও শহীদ হয়েছেন আরও ৯ জন তরুণ।

ফয়সাল সরকার (২৪)—ঢাকার আব্দুল্লাহপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এবং তাঁকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়।

সাগর মিয়া (১৯)—মিরপুর ১০-এ পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান।

হোসাইন মিয়া (১০)—একজন শিশু পপকর্ন বিক্রেতা, নিহত হন চিটাগাং রোডে।

কাদির হোসেন সোহাগ (২২)—নিহত হন গোপীবাগে, পাঠাও কুরিয়ারে কর্মরত ছিলেন।

জহিরুল ইসলাম রাসেল—নিহত হন গুলিস্তানে।

রবিন মিয়া (৩৫)—যাত্রাবাড়িতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।

রায়হান রাব্বি—খিলগাঁও তালতলায় পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন।

সাইফুল ইসলাম তন্ময় ও নাজমুল হাসান—উভয়েই পুলিশের গুলিতে নিহত হন, নাজমুল বাড্ডায় কাজ করতেন।


এই ১২ জন শহীদের আত্মত্যাগ শুধু দেবীদ্বারের নয়, গোটা দেশের গণতন্ত্র, ন্যায়ের লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে আছে। শহীদ পরিবারগুলো আজও বিচার ও স্বীকৃতির আশায় প্রহর গুনছে।


আজও আহত আবুবকরের পরিবারের একটাই দাবি—সরকার যেন উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। শহীদের সন্তানরা যেন ভালোভাবে বাঁচে, পায় সঠিক শিক্ষা ও মানবিক ভবিষ্যৎ।


এই ইতিহাস শুধু স্মরণ করার জন্য নয়, শিক্ষা নেওয়ারও। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং গণতন্ত্র রক্ষায় আত্মত্যাগের এমন উদাহরণ অনন্তকাল বেঁচে থাকবে।

লেখক পরিচিতি :মমিনুল ইসলাম মোল্লা, সাংবাদিক কলামিস্ট ও রাজনীতি বিষয়ক লেখক, কুমিল্লা।।

No comments

Theme images by mammuth. Powered by Blogger.