স্তর বিন্যাস ছাড়া উপজেলা কার্যকর হবে না।

 

স্তর বিন্যাস ছাড়া উপজেলা কার্যকর হবে না।
---------------- মমিনুল ইসলাম মোল্লা, সাংবাদিক, কলামস্টি ও সাহিত্যিক,কুমিল্লা ।।ল্লা 

সরকারি বিধি-বিধান ও বই পুস্তুকে উপজেলাকে কয়েকটি ইউনিয়নের সমষ্টি বলা হলেও ৩১৫টি উপজেলার আয়তনের মধ্যে পৌরসভা রয়েছে। সেজন্য এটিকে শুধু মাত্র গ্রামীণ ইউনিট বলা যুক্তিযুক্ত নয়।  বর্তমানে দেশের ৭টি বিভাগে মোট ৬৪টি জেলায় ৪৮৭টি উপজেলা রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ১৯ ফেব্রুয়ারী দেশের ৯৭টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।  মে মাসের মধ্যে ৬টি ধাপে এ নির্বাচন চলছে। গত ৫ জানুয়ারি জাতীয়  নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণ না থাকায় জনগণ আগ্রহ সহকারে ভোট প্রদান করেনি । সেজন্য বর্তমান উপজেলা নির্বাচনে আনন্দ সহকারে ভোট প্রদান করছে। গ্রাম-বাংলায় উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।  নিয়মানুযায়ী স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রভাব না থাকার কথা থাকলেও পরোক্ষভাবে রাজনীতির ছায়া পড়ছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দিচ্ছে। জনসাধারণ ও প্যানেলভূক্ত প্রার্থীদের ভোট দিচ্ছেন। এর আগে পূর্ববর্তী উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় গত ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি । বাংলাদেশে উপজেলার সূচনা হয় আশির দশকে। ১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর স্থানীয় সরকার ( উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা পুনর্গঠন ) অধ্যাদেশ এর মাধ্যমে থানা গুলোকে আপগ্রেড করে  উপজেলা পরিষদ গঠন করা হয় এবং উপজেলা পর্যায়ে বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। ১৯৯১ সালে উপজেলা পরিষদ বাতিল করা হয়। তারপর ১৯৯৮ সালে তা আবার প্রাণ ফিরে পায়। ১৯৯৮ সালে জাতীয় সংসদে উপজেলা অধ্যাদেশ ১৯৯৮ পাস করে পূনরায় উপজেলা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়। বর্তমানে উপজেলা পরিষদে একজন চেয়ারম্যান, একজন পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান ও একজন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ছাড়াও ইউনিয়ন/পৌরসভার চেয়ারম্যানগন উপজেলা পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রথম মিটিং থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত এ পরিষদের কার্যকাল বহাল থাকবে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নীতি নির্ধারণী বিষয়ে সংসদীয় বিতর্কে অংশগ্রহণ , আইন প্রনয়ন ও সংশোধন, এবং পার্লামেন্টারী স্ট্যন্ডিং কমিটিতে অংশগ্রহণই সংসদ সদস্যদের কাজ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এমপিরা স্থানীয় ব্যাপারেও হস্তক্ষেপ করছেন। ফলে উপজেলা সহ অন্যান্য স্থানীয় ইউনিটগুলো কার্যকর হচ্ছে না । 
উপজেলা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও এমপিদের অহেতুক হস্তেক্ষপ রোধ করার জন্য গত মেয়াদে নির্বাচিত বাংলাদেশ উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান ঐক্য পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক ও জয়পুরহাটের আক্কেলপুরের উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ারুল হক বাবলু একটি রিট দায়ের করেন। ১৭টি বিভাগের দায়িত্ব উপজেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করার জন্য একটি রিটটি করা হলেও আজও তার মিমাংসা হয়নি।  বর্তমান আইন অনুযায়ী উপজেলা পরিষদের ক্ষমতা খুবই সীমিত। তবে তত্তাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালে প্রণীত বিধিমালায় পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল বলে বিজ্ঞমহল মনে করেন।  ২০০৯ সালের ২০ এপ্রিল উপজেলা পরিষদ ( রহিতকরণ, আইন, পুনঃপ্রবর্তন ও সংশোধন)  আইনের মাধ্যমে উপজেলা পরিষদকে পঙ্গু করে দেয়া হয় বলে ভুক্তভোগীরা মনে করেন। স্থানীয় সরকার আইন ২০০৯ অনুযায়ী সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের অধীন একক আঞ্চলিক এলাকা হতে নির্বাচিত সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্য পরিষদের উপদেষ্টা হবেন। পরিষদ উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবেন । অথচ পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের আইনে এমপিদের উপদেষ্টা হিসাবে রাখা হয়নি। নবনির্বাচিত চেয়ারম্যানগণ বলেন, ‘আমাদের হাত-পা বাঁধা। জনগণ যে আশা-আকাঙ্খা নিয়ে আমাদের নির্বাচিত করেছে আমরা তা কতটুকু পূরণ করতে পারব জানিনা। আইন অনুযায়ী এমপি সাহেবের অনুমতি বাদে আমরা সরকারের নিকট কোন প্রকার যোগাযোগ করতে পারবো না। ” তাই এমপি সাহেবরা প্রায় উপজেলা গভর্ণরের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন বলা যায়। উপজেলা পরিষদে এমপিদের উপদেস্টা করার ব্যাপারটি সংবিধান বহির্ভুত। সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ অনুযাযী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের বা স্তরের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হবে। মূলত এমপিদের কর্তৃত্ব দেয়ার কারণেই গত ৫ বছরের অধিকাংশ সময় কেটেছে উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যদের ঝগড়া-বিবাদের মধ্য দিয়ে। কেউ কেউ বলেন- মাসে ৪/৫ দিন উপস্থিত থাকলেই দাপ্তরিক কাজ শেষ হয়ে যায়। একজন চেয়ারম্যান ক্ষোভের সাথে বলেন- উপজেলা পর্যায়ের ১৭টি বিভাগের ৭০টি কমিটির মাধ্যমে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়। এসব কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আর উপদেষ্টা সংসদ সদস্যরা। কাজগুলো মূলত ইউএনও এবং সংসদ সদস্যগণ মিলেই করে ফেলেন। গত মেয়াদে গঠিত বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক বদিউজ্জামান বাদশা বলেন, এভাবে অকার্যকর করে রাখলে কখনও জনগণের সেবা করা সম্ভব হবে না। এমপিদের অনৈতিক হস্তক্ষেপ সাধারণ মানুষই একদিন প্রতিরোধ করবে। কারণ সংসদ সদস্যদের কাজ আইন প্রণয়ন করা , রাস্তাঘাট ঠিক করা নয়। উপজেলা চেয়ারম্যানদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে উপজেলা চেয়ারম্যানগণ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী থেকে বছরে ৮২ লক্ষ টাকা, টিআর ও কাবিখা বরাদ্দ থেকে ২০ শতাংশ এবং ভূমি হস্তান্তর করের ১ শতাংশ পেয়ে থাকেন, যা দিয়ে উপজেলার জনসাধারণের চাহিদা কোনোভাবেই পূরণ করা সম্বব নয়। গত মেয়াদে চেয়ারম্যানদের পদমর্যাদা বৃদ্ধি করা হলেও ক্ষমতা না থাকায় তারা শুধু বিভিন্ন সামাজিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেই সময় কাটিয়েেেছন। উপজেলার কাজগুলো সঠিকভাবে সম্পাদন করার জন্য ৭টি স্ট্যান্ডিং কমিটি গঠন করা হয়। এগুলো হচ্ছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা , স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, কৃষি, সেচ, ও পরিবেশ, শিক্ষা, সমাজ কল্যাণ , নারী, শিশু উন্নয়ন, যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়ন। তবে মূল কাজগুলো দুইভাগে বিভক্ত। সংরক্ষিত কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে- আইন শৃংখলা রক্ষা, দেওয়ানী, ও ফৌজদারী, বিচার, রাজস্ব প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ, বৃহৎ শিল্প, খনন কার্য এবং খনিজ সম্পদের উন্নয়ন ইত্যাদি। এছাড়া হস্তান্তরিত দায়িত্বের মধ্যে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। আন্তঃ উপজেলা সড়ক নির্মাণ ও সংরক্ষণ, কৃষি সমাপ্রসারণ, ও কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষি উপকরণ ও সেচ ব্যবস্থা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরেণ, বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রণয়ন ইত্যাদি কার্যক্রম রয়েছে।  আন্তঃ উপজেলা পর্যায়ে কাজ করার জন্য ১১০ টি কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে ৮৫ টির সভাপতি ইউএনও। ভিজিডি কমিটি, পুনর্বাসন কমিটির সভাপতিও ইউএনও। তিনি এসব কাজে উপজেলা চেয়ারম্যানের সুপারিশ গ্রহণ করেন না, প্রয়োজনে এমপি সাহেবের দ্বারস্থ হন। উপজেলা পরিষদকে সঠিকভাবে কার্যকর করতে হলে কেন্দ্রীয় সরকারকে কিছু দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে। বিবাহ-বিচ্ছেদ থেকে শুরু করে চুরি-ডাকাতির মামলা সবই কেন্দ্রীয় সরকার করলে স্থানীয় সরকারের মর্যাদা হ্রাস পাবে এটাই স্বাভাবিক। স্থানীয় সংসদ সদস্যগণ যদি কচুরিপানা নির্মূলকরণ থেকে শুরু করে গ্যাস ও তৈল অনুসন্ধান কেন্দ্র তদারকি করেন, তাহলে উপজেলা চেয়ারম্যানগণ জনগণের  সেবা করার সুযোগ পাবেন কোথায়?
এ জন্য গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সিডিএলজি’(সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক লোকাল গভর্নেন্স)  বিষয়টি নিয়ে লাগাতার ক্যাম্পেইন করে আসছে। তাদের মতে স্থানীয় সরকারকে কার্যকর করতে হলে প্রথমতঃ দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা তথা কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বাস্তাবায়ন করতে হবে। তারপর স্থানীয় সরকারের সমন্বিত স্তর বিন্যাস করে স্থানীয় কাজগুলো স্থানীয় ইউনিট গুলোর মধ্যে বিভাজন করে দিতে হবে। অর্থাৎ ইউনিয়নকে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের এবং পৌরসভা/সিটি করপোরেশনকে নগরীয় স্থানীয় সরকারের সর্বনি¤œ স্তর হিসাবে ঘোষণা দিতে হবে। বিভাগ অথবা জেলাকে সবোচ্চ স্তর করে গ্রামীণ ও নগরীয় ইউনিটগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার একক ক্ষমতা দিতে হবে। উপজেলার আয়তনের মধ্যে কোন পৌরসভা থাকবে না। উপজেলা হবে গ্রামীণ স্থানীয় সরকারের মধ্যবর্তী স্তর। ইউনিয়ন যে কাজগুলো করতে পারবে না সে গুলো উপজেলা বাস্তবায়ন করবে। অনেকে উপজেলাকে স্থায়ী প্রতিষ্ঠান মনে করেন। বাস্তবে ইউনিয়নগুলো পৌরসভায় রুপান্তরিত হলে উপজেলা বিলুপ্তি ঘটবে। সেজন্য আগামীর গণতান্ত্রিক নগরীয় বাংলাদেশের জন্য এখনই একটি উপযুক্ত ডিজাইন গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় শুধু উপজেলাই নয়, কোন স্থানীয় সরকারই কার্যকর হবে না।  
 লেখকঃ মমিনুল ইসলাম মোল্লা,গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের ক্যাম্পেনার, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের  প্রভাষক ও সাংবাদিক, কুমিল্লা।

No comments

Theme images by mammuth. Powered by Blogger.