কুমিল্লার দৌলতপুরে নজরুল ইসলামের সাহিত্য কর্ম
মমিনুল ইসলাম মোল্লা সাংবাদিক কলামেস্ট ও সাহিত্যিক কুমিল্লা।।
কুমিল্লার দৌলতপুরে (যা বর্তমানে মুরাদনগর উপজেলার অধীনে) কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১ সালের এপ্রিল থেকে ১৯২২ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রায় এগারো মাস অবস্থান করেছিলেন। এই সময়কালটি তার সাহিত্যিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এটি তার জীবনে প্রেম, বিদ্রোহ এবং সৃজনশীলতার এক অসাধারণ অধ্যায়। দৌলতপুরে থাকাকালীন তিনি সৈয়দা নרגিস আসার খানমের (পরে তার প্রথম স্ত্রী) বাড়িতে অবস্থান করেন এবং এখানেই তার সৃষ্টির এক বিশাল অংশ রচিত হয়।
দৌলতপুরে নজরুল ইসলাম অসংখ্য গান, কবিতা, গজল ও নাটক রচনা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নিচে দেওয়া হলো:
কবিতাসমূহ:
দৌলতপুরে রচিত তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো:
* 'বিদ্রোহী' কবিতা (প্রথম অংশের খসড়া): যদিও 'বিদ্রোহী' কবিতার চূড়ান্ত রূপ ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় প্রকাশিত হয়, ধারণা করা হয় এর প্রথম দিকের খসড়া এবং মূল ভাবনা দৌলতপুরেই শুরু হয়েছিল। এই সময়কালে তার মানসিক অস্থিরতা এবং বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ এই কবিতার পেছনে কাজ করেছে।
* 'কামাল পাশা': এই দীর্ঘ কবিতাটি কামাল আতাতুর্কের তুর্কি স্বাধীনতা আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় রচিত।
* 'শাত-ইল-আরব': এটি একটি যুদ্ধ-ভিত্তিক কবিতা, যা মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা।
* 'খেয়াপারের তরণী': আধ্যাত্মিক এবং দেশাত্মবোধক এই কবিতাটিও দৌলতপুরের রচনা।
* 'কোরবানি': ঈদ-উল-আযহার ত্যাগের মহিমা নিয়ে রচিত এই কবিতা।
* 'মোহররম': কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে রচিত আবেগঘন কবিতা।
* 'ফাতেহা-ই-দোয়াজ-দাহম': মহানবী (সা.)-এর জন্মদিন ও ওফাত দিবস নিয়ে রচিত।
* 'আনোয়ার': এটি একটি মর্সিয়া বা শোককাব্য, যা মহররমের প্রেক্ষাপটে রচিত।
* 'রণভেরী': যুদ্ধের আহ্বানমূলক কবিতা।
* 'শৃঙ্খল-পরা গান': পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার গান।
* 'আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে': প্রেমের আনন্দ ও সৃষ্টির উল্লাস নিয়ে লেখা।
* 'অবেলা': প্রেম ও বিরহের একটি কবিতা।
* 'ব্যথার দান' (গল্পগ্রন্থ): যদিও এটি গল্পগ্রন্থ, এর কিছু অংশের ভাবনা বা লেখালিখি এই সময়ে শুরু হতে পারে।
গান ও গজলসমূহ:
দৌলতপুরে থাকাকালীন নজরুল অসংখ্য গান ও গজল রচনা করেছেন, যার মধ্যে অনেকগুলো প্রেমের গান এবং গজল রয়েছে যা নর্গিসের প্রতি তার গভীর অনুভূতিকে প্রকাশ করে। যদিও সব গানের সুনির্দিষ্ট তালিকা দেওয়া কঠিন, তবে এই সময়ে তার গানের ধারায় একটি নতুন মাত্রা যোগ হয়।
* প্রেম ও বিরহের গান: নর্গিসের সাথে তার সম্পর্কের প্রভাবে অনেক প্রেম এবং বিরহের গান রচিত হয়।
* ইসলামী গান ও গজল: ইসলামী গান ও গজল রচনাতেও এই সময় তিনি বিশেষ মনোযোগ দেন। 'শাত-ইল-আরব', 'কোরবানি' ইত্যাদি কবিতার পাশাপাশি অনেক ইসলামী গানের সুরও এই সময়ে তার মনে আসে।
নাটক:
* 'জাগ্রত তুর্কি': এটি একটি নাটক যা তুর্কি স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে রচিত।
দৌলতপুর ছিল নজরুলের সৃজনশীলতার এক উর্বর ভূমি। এখানেই তিনি একাধারে প্রেমিকের আবেগ, বিদ্রোহীর তেজ এবং আধ্যাত্মিকতার গভীরতা নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন, যা পরবর্তীকালে তার 'অগ্নিবীণা' কা
ব্যগ্রন্থে স্থান পায়।
No comments