হাশরের ময়দানে পাপীরা আযাব ভোগ করবে

হাশরের ময়দানে পাপীরা আযাব ভোগ করবে

মমিনুল ইসলাম মোল্লা,
হাশরের দিন সকল মানুষ এক বিশাল মাঠে উপস্থিত হবে। এ মাটির রং হবে কিছুটা লাল-সাদা মিশ্রিত। বর্তমানের অসমতল পৃথিবীকে তখন সমতল করা হবে। এটি হয়ে যাবে অনেকটা সাফাই করা আটার রুটির মত। সে জমিনে কারো কোন ঘর-বাড়ির চিহ্ন থাকবে না।ইসরাফিলের শিঙ্গার আওয়াজ শুনে সবাই গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে।কিয়ামতের দিন লোকজন একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবে। একদল তারা বেহেস্তের আশা রাখবে আর একদল তারা দোজখের ভয়ে ভীত থাকবে।  তবে সকলের হাশরের ময়দানে যাওয়ার পদ্ধতি এক রকম হবে না।  কেউ কেউ উটে যাবে, কোন কোন উটে দুজন, কোন কোনটিতে তিন জন, চার জন এমনকি কোনটিতে দশজনও থাকবে। তারা সেগুলোতে পালাক্রমে চড়বে।কিন্তু পাপীদের অবস্থা হবে ভিন্ন। দিনের আলোয় তার যখন অবস্থান করবে তাদের সাথে আগুন থাকবে। আগুন তাদেরকে একদিকে জড় করবে। তারা রাতে যেখানে অবস্থান করবে আগুনও সেখানে থাকবে। অনুরুপভাবে ভোরে ও সন্ধায় তারা সেখানে থাকবে , আগুনও তথায় তাদের সাথে থাকবে। কাফিররা পায়ে হেঁটে সেখানে যাবেনা। তাদেরকে মুখের উপর ভর করে সেখানে হাজির করা হবে। হযরত আনাস (রাঃ)  থেকে বর্ণিত একদিন জনৈক ব্যক্তি বল্ল,ইয়া রাসুলুল্লাহ কিয়ামতের দিন কাফেরদেরকে কিভাবে মুখের উপর হাঁটিয়ে জড় করা হবে ? উত্তরে তিনি বল্লেন, যিনি দুনিয়াতে মানুষকে দু পায়ে চালিয়েছিলেন তিনি কি কিয়ামতের দিন তাকে মুখের উপর ক্ষমতা রাখেন না  ? (মুসলিম) সুদ খাওয়া কবিরা গুনাহ। যারা সুদ খায় তারা হাশরের ময়দানে স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপিত হবে না। সুদখোরেরা সেদিন তার ন্যয় কবর থেকে উঠবে শয়তান যাকে স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দেয়।  এজন্য যে তারা বলে, বেচা-কেনা সুদের মতই , অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। যারা আল্লাহর স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে তাদের জীবন হবে সংকুচিত আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে হে আমার রব কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন আথচ আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন? তিনি বলবেন, এমনভাবেই তোমার নিকট আমার নিদর্শনাবলী এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে, এবং সেভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হল।(ত্বহা-১২৪-১২৬)অবধৈভাবে অর্জিত সম্পদ নিয়ে অর্জনকারী কিয়ামতের ময়দানে হাজির হবে। হযরত আদী ইবনে উমায়ের (রাঃ)  বর্ণনা করেন, আমি রাসুলে আকরাম ( সাঃ )   কে বলতে শুনেছি আমরা তোমাদের কাউকে কোন সরকারি পদে নিয়োগ করলাম । এরপর সে একটা সুচ পরিমান অথবা তার চেয়ে বেশি কিছু যদি আমাদের থেকে গোপন করে তবে সে খেয়ানতকারীরুপে গন্য হবে। সে কেয়ামতের দিন তা নিয়ে হাযির হবে। ( মুসলিম)
বর্তমানে সূর্য পৃথিবী থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। এতদূরে থাকার পরও আমরা চৈত্র-বৈশাখ মাসে রোদ্রের তাপ সহ্য করতে পারিনা। গরমে হাপিয়ে যাই। আর সে সূর্য যদি ১ মাইল কাছে  আসে তাহলে এর তাপ কত ডিগ্রি হতে পারে তা  আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বাদে কেউ বলতে পারবেন না। সেদিনকার কঠিন অবস্থা থেকে আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। কঠিন হাশরের ময়দানে গাছ-পালা ,  লতা-পাতা কিছুই থাকবে না। সুতরাং সূর্য তাপ থেকে রক্ষা করার মতো কিছুই থাকবে না। সেখানে শুধুমাত্র আরশের ছা’য়া থাকবে। হাশরের ময়দানে পাপীরা  প্রচন্ড তাপের কারণে ঘামতে থাকবে। এ ঘাম সকলের জন্য সমান হবে না। পাপের মাত্রা অনুযায়ী এর পার্থক্য হবে। কারো পায়ের ঘাট পর্যন্ত, কারো হাঁটু পর্যন্ত , আবার কারো বা নাক পর্যন্ত ঘামে ডুবে যাবে ( বোখারি ও মুসলিম)। হাশরের ময়দানের অসহ্য অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ ব্যাকুল হয়ে উঠবে। মুসলিম শরিফে বর্ণিত হয়েছে- আবু কামিল ফুযায়েল ইবনু হুসায়ন আল জাহদারী ও মুহাম্মদ ইবনু আল শুবারী (রহ ঃ )   আনাস উবনু মালিক (রাঃ)  থেকে বর্ণিত যে, রাসুল ( সাঃ )   এরশাদ করেছেন, হাশরের মাঠে আল্লাহ সকল মানুষকে একত্রিত করবেন। তখন সংকট মুক্তির জন্য সুপারিশ প্রার্থনার ব্যাপারে তারা তৎপর হবে। তারা বলবে আমরা যদি কাউকে আল্লাহর কাছে সুপারিশের জন্য অনুরোধ করতাম, যেন তিনি আমাদের সঙ্কটময় স্থান থেকে মুক্তি দেন। সে মতে তারা হযরত আদম ( আঃ )  , হযরত নুহু ( আঃ )  , হযরত ইব্রহীম ( আঃ )   , হযরত মুসা ( আঃ )   , হযরত ঈসা ( আঃ )   এর কাছে আসবে । তিনি বলবেন তোমরা হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ )  এর কাছে যাও। তখন তিনি আল্লাহর দরবারে সেজদায় পড়ে যাবেন। আল্লাহ এক সময় বলবেন হে  মুহাম্মদ মাথা উঠাও তোমার সুপরিশ কবুল করা হবে ( সংক্ষেপিত)। সাইদ ইবনে যায়েদ (রাঃ)  থেকে বর্ণিত , তিনি বলেন, আমি রাসুল ( সাঃ ) কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি জোরপূর্বক কারো জমিন ছিনিয়ে নিবে শেষ বিচারের দিবসে তার কাঁধে সাত তবক জামিন ঝুলিয়ে দেয়া হবে ( বোখারি) । আমর ইবনে শুআইব (রাঃ)  তার পিতা থেকে তিনি তার দাদা তিনি রাসুল ( সাঃ )   থেকে বর্ণনা করেছেন , তিনি বলেছেন, শেষ বিচার দিবসে অহংকারীদেরকে পিঁপিলিকার মত মানুষ আকৃতিেিত একত্রিত করবেন।
হাশরের ময়দানে প্রত্যেক নবী তাদের উম্মতের নিকটে থাকবেন। গায়ের ঘামে এবং পানির পিপাশায় অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ তখন পানির সন্ধান করবে। কিন্তু হাউজে কাউসারের পানি বাদে আর কোথাও পানি পাওয়া যাবে না। নবিজি আগেই সেখানে গিয়ে হাজির হবেন। নবিজিী তার নামাজী উম্মতদেরকে সেদিন চিনতে পারবেন। যারা সঠিকবাবে উযু করে নামাজ আদায় করেছে তাদের ওযুতে ধোয়া অঙ্গ প্রত্যেঙ্গগুলা সেদিন জ্বল জ্বল করতে থাকবে। হাদিস শরিফে হাইজে কাউসারের পানির বর্ণনা পাওয়া যায়। এ পানি দুধের চেয়েও সাদা এটি মৃগনাভীর চেয়েও বেশি সুগন্ধীযুক্ত। এ পান পাত্র সমুহ হবে আকাশের তারকার মত অধিক উজ্বল । যে তা থেকে একবার পান করবে সে আর তৃষœার্ত হবে না। এতে দুটি জল ধারা থাকবে একটি সোনার ও অন্যটি চান্দির। কাউছারের উভয় পাশে গর্ভশূণ্য মুক্তার গম্বুজ সাজানো থাকবে। এর মাটি মিশকের ন্যায় সুগন্ধময়। এ হাউজের প্রশস্ততা এক মাসের পথের সম পরিমান আর তার চারদিকেও এক মাসের পথের সমান। বোখারি ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত সাহল ইবনে সাদ ((রাঃ) ) বলেন, রাসুল ( সাঃ )   বলেছেন, আমি তোমাদের আগেই হাউজে কাউসারে পৌঁছব । যে ব্যক্তি আমার কাছে পৌঁছবে সে তার পানি পান করবে। আর যে একবার পানি পান করবে সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না। আমার কাছে এমন কিছু লোক আসবে যাদেরকে আমি চিনতে পারব এবং তারাও আমাকে চিনতে পারবে। অতঃপর আমার ও তাদের মধ্যে আড়াল করে দেয়া হবে। তখন আমি বলব, এরা তো আমার উম্মত। তখন আমাকে বলা হবে, আপনি জানেন না আপনার অবর্তমানে তারা যে কি সব নতুন নতুন মত ও পথ আবিষ্কার করেছে। একথা শুনে আমি বলব যারা আমার অবর্তমানে আমার দ্বীনকে পরিবর্তন করেছে তারা দূরে যাও।
হাশরের ময়দানে সবাই প্রভূর সাথে কথা বলবেন। তখন বান্দা ও প্রভূর মাঝখানে কোন দোভাষী অথবা কোন পর্দা থাকবে না। পাপীরা তাদের ডানে তাকাবে, তখন আগে প্রেরিত আমল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। আর সামনের দিকে তাকালে দোজখ ছাড়া কিছুই দেখতে পাবে না। যা একবারে চেহারার সামনে অবস্থিত থাকবে। প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ)  থেকে বর্নিত রাসুল ( সাঃ )   ইরশাদ করেছেন, কেয়ামতের দিন জাহান্নামকে উপস্থিত করা হবে। তার সত্তর হাজার রশি থাকবে, প্রত্যক রশির সাথে সত্তর হাজার রশি থাকবে যারা তাকে টেনে আনবে ( মুসলিম)।  আর জাহান্নামের গভীরতা সম্পর্কেও অন্য এক হাদিসে বলা হয়েছে,  সেখানে একটি পাথরখন্ড ফেল্লে তা পৌঁছতে সত্তর বছর সময় লাগবে। কেয়ামতের দিন পাপীদের উদ্দেশ্যে ফেরেস্তাদেরকে বলা হবে, ধর একে গলায় বেড়ী পরিয়ে দাও , অতঃপর নিক্ষেপ কর জাহান্নামে। অতঃপর তাকে শংখলিত কর সত্তর গজ দীর্ঘ এক শিকলে। আল্লাহতে বিশ্বাসী  ছিলনা, মিসকিনকে খাবার দিতনা, এ ধরণের লোক এ অবস্থায় পতিত হবে। যারা যাকাত দেয়নি কিয়ামতের দিন ত্াদেরকে সাপের দংশনে কষ্ট দেয়া হবে। যে সম্পদের যাকাত দেয়া হয়নি তা অবধৈ সম্পদ। এ সম্পদ সাপ হয়ে মুখ হা করে তাকে ধাওয়া করতে থাকবে।আর সে পালাতে চেষ্টা করবে। যখন দেখবে সে কোনভাবেই নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না তখন সে নিজেই তার মুখে হাত ঢুকিয়ে দেবে। সাপটি তখন তাকে এমনভাবে গ্রাস করবে ও যেমন উট ঘাস মুখে নেয়। কারো জমিন বা বাড়ি যবর দখলকারী ( শেষ বিচারের দিবসে) সাত তবক জমিন কাঁধে ঝুলন্ত অবস্থায় হাশরের মাঠে হাজির হবে। চোর তার চুরিকৃত সম্পদ নিয়ে হাজির হবে। আবু হুরায়রা (রাঃ)  হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল্লাহ ( সাঃ )   বলেছেন- প্রত্যেক সোনা  –রুপার মালিক যে তার হক্ব ( যাকাত) আদায় করে না। কিয়ামতের দিন তার জন্য বহু পাত তৈরি করা হবে, এবং সেগুলো জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তার পাঁজর কপাল ও পিঠে দাগ দেয়া হবে। যখনই তা ঠান্ডা হবে, তখনই তা গরম করা হবে। ( তার এ শাস্তি চলতে থাকবে) সেই দিনে যার পরিমান হবে পঞাশ হাজার বছরের সমান। সকল বান্দার বিচার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তার এ অবস্থা চলতে থাকবে। অতঃপর সে তার পথ ধরবে হয় জান্নাতের দিকে না হয় জান্নমের দিকে। যারা পশুর যাকাত আদায় না করেন তারা হাশরের ময়দানে কঠোর আযাব ভোগ করবে। কোন উটের মালিক যদি যাকাতের হক আদায় না করে কিয়ামতের দিন এক প্রশস্ত বিশাল ময়দানে তাকে উপুড় করে ফেলা হবে এবং তার সকল উট যা একটি বাচ্চাকেও হারাবে না পূর্ণভাবে তাকে ক্ষুর দ্বারা মাড়াতে থাকবে ও মুখ দ্বারা কামড়াতে থাকবে। এভাবে যখনই তাদের শেষ দল অতিক্রম করবে পুনরায় প্রথম দল এসে পৌঁছবে। আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে বিচার –মীমাংশা না হওয়া পর্যন্ত। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে ,আর আল্লাহ যাদেরকে সম্পদশালী করেছেন অথচ তারা সে সম্পদ নিয়ে কার্পন্য করে , তাদের ধারণা করা উচিত নয় যে সেই সম্পদ তাদের জন্য কল্যান বয়ে আনবে, বরং উহা তাদের জন্য অকল্যানকর হবে। অচিরেই কেয়ামত দিবসে , যা নিয়ে তারা কৃপনতা করেছে সে সমস্ত সম্পদকে কিয়ামতের দিন তাদের গলায় বেড়ি বানিয়ে পরানো হবে। আর আল্লাহ হচ্ছেন আসমান যমিনের পরম সত্বাধীকারী । আর যা কিছু তোমরা কর ; আল্লাহ সে সম্পর্কে জানেন ( আল ইমরান১৮০)। আবু হোরায়রা (রাঃ)  থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন, রাসুল ( সাঃ )   বলেছেন, যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন কিন্তু সে এর যাকাত আদায় করেনি, কেয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে । সাপটি তার মুখের দু পার্শ্বে কামড়ে ধরে বলবে, অরমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত মাল। যারা মিথ্যা কসম করে ব্যবসা করে অথবা অর্থ আত্মসাৎ করে কিয়ামতের দিন তারা আল্লাহকে রাগান্বিত অবস্থায় পাবেন। লেখকঃ গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের ক্যাম্পেনার, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের  প্রভাষক ও সাংবাদিক
   কুমিল্লা। তারিখঃ ১২.০৩.১৭














No comments

Theme images by mammuth. Powered by Blogger.