হাদিসের সঠিকতা নিরুপনে নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) এর অবদান
হাদিসের সঠিকতা নিরুপনে নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) এর অবদান
porichoy আল্লামা মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহ.) আধুনিক যুগে মুসলিম জাহানের একজন স্বনামধন্য আলেম। আধুনিক বিশ্বে শাইখ আলবানীকে ইলমে হাদীসের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ইলমুল জারহে ওয়াত তাদীলের[1] ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রতিভাধারী আলেম হিসেবে গণ্য করা হয়। ইলমে মুস্তালাহুল হাদীসের[2] ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বক্তিত্ব। মুহাদ্দিসগণ বলেছেন: “তিনি যেন ইবনে হাজার আসকালানী, হাফেয ইবনে কাসীর প্রমুখ ইলমুল জারহে ওয়াত তাদীলের আলেমদের যুগকে আবার ফিরিয়ে এনেছিলেন।”
bongsho porichoy ✔ জন্ম ও পরিচয়:নাম: মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন
(১৯১৪-১৯৯৯ খৃষ্টাব্দ) পিতার
নাম: আলহাজ্ব নূহ। দাদার
নাম: নাজাতী। ডাক
নাম: আবু আব্দুর রহমান। ইউরোপের
মুসলিম অধ্যুষিত দেশ আলবেনিয়ায় তার
জন্ম হওয়ায় তাকে আলবানী বলা
হয়। তিনি
১৩৩৩ হিজরী মোতাবেক ১৯১৪
খৃষ্টাব্দে আলবেনিয়ার রাজধানী স্কোডার (Shkodër -বর্তমান নাম তিরানা) এ
জন্ম গ্রহণ করেন।
তার পরিবার ছিল দরিদ্র। কিন্তু
দীনদারী ও জ্ঞানার্জন তাদের
দারিদ্রতার উপর ছিল বিজয়ী।
Shikha jibon ✔ শিক্ষা
জীবন:
দামেস্ক
আসার পর আলবানীর বয়স
নয় বছরের কাছাকাছি হলে
তার পিতা তাকে সেখানকার
‘স্কুল অব এইড চ্যারিটি’
নামক একটি স্কুলে ভর্তি
করিয়ে দেন। সেখানেই
তিনি কৃতিত্বের সাথে প্রাথমিক শিক্ষা
সমাপ্ত করেন।প্রচলিত
একাডেমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দীন
সম্পর্কে ভাল জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা
ছিল না। বিধায়
তার পিতা এসব শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানে নিজ ছেলের পড়া-শোনার ক্ষেত্রে ভিন্ন
দৃষ্টি পোষণ করতেন।
এ কারণে, তিনি নিজে
সন্তানের জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষা
সিলেবাস তৈরি করে তার
মাধ্যমে তাকে আল কুরআনুল
কারীম, তাজবীদ, নাহু, সরফ এবং
হানাফী ফিকাহ ইত্যাদি বিষয়
শিক্ষা দিতে লাগলেন।
তিনি তার পিতার কাছেই
হাফস বিন আসেম এর
রেয়াওয়াত অনুযায়ী কুরআনের হিফয সমাপ্ত করেন।
Gori meramot
তিনি তার পিতার কাছেই ঘড়ি
মেরামতের কাজ শিখেন এবং
এ ক্ষেত্রে সুখ্যাতি অর্জন করেন।
এরপর তিনি ঘড়ি মেরামতকেই
জীবীকার পেশা হিসেবে বেছে
নেন। এই
পেশায় তিনি ব্যক্তিগত পড়া-লেখা ও বিভিন্ন
কিতাবাদী অধ্যয়নের পর্যাপ্ত সময় পান।
এভাবে সিরিয়ায় হিজরতের মাধ্যমে তার জন্যে আরবী
ভাষা ও মূল উৎস
থেকে শরীয়তের জ্ঞানার্জনের পথ সুগম হয়।
✔ হাদীস
অধ্যয়ন: হাদীস অধ্যয়নের প্রতি
তার মনোনিবেশ: মাত্র বিশ বছর
বয়সে তিনি হাদীসের ক্ষেত্রে
যথেষ্ট বুৎপত্তি অর্জন করেন।
এবার তিনি হাদীসের সেবায়
কলম ধরলেন। সর্ব
প্রথম যে কাজটি করলেন
তা হল, তিনি হাফেজ
ইরাকী (রহ.) এর লিখা
“المغني عن حمل الأسفار في تخريج ما في الإحياء من الأخبار” নামক
কিতাবটি কপি করে তাতে
টিকা সংযোজন করলেন।শাইখের এই কাজটি
তার সামনে হাদীস নিয়ে
গবেষণার বিশাল দরজা খুলে
দেয়। এরপর
ইলমে হাদীস নিয়ে গবেষণা
করা তার প্রধান কাজে
পরিণত নয়। ক্রমেই
তিনি দামেস্কের ইলমী জগতে এ
বিষয়ে পরিচিতি লাভ করেন।যার পরিপ্রেক্ষিতে দামেস্কের
জাহেরিয়া লাইব্রেরী কর্তৃপক্ষ তার জন্য বিশেষ
একটি কক্ষ নির্ধারণ করে
দেয়, যেন তিনি সেখানে
অবস্থান করে গবেষণা কর্ম
চালাতে পারেন। সেই
সাথে লাইব্রেরীর একটি চাবিও তাকে
দেয়া হয় যেন তিনি
যখন খুশি তাতে প্রবেশ
করতে পারেন।
Salafi
chetona আল্লাহর রাসূল
(ﷺ)-এর হাদীসের সাথে যুক্ত থাকার
কারণে শাইখ আলবানীর মধ্যে
সালাফী চিন্তা-চেতনার বিকাশ
ঘটে। সেই
সাথে সালাফী ধারার বিশ্ব
বরেণ্য আলেম শাইখুল ইসলাম
ইবনে তাইমিয়া এবং তার ছাত্র
ইবনুল কাইয়েম (রহ.) রচিত গ্রন্থাদী
অধ্যয়ন করার ফলে এই
রীতির উপর তার দৃঢ়তা
আরও মজবুত হয়।
Mazhab
birodi শাইখ আলবানী
এবার সিরিয়ায় তাওহীদ ও সুন্নাহর
দিকে দাওয়াতের পতাকা তুলে ধরলেন। ফলে
সিরিয়ার অনেক আলেম ওলামা
তার সাক্ষাতে আসেন এবং শাইখ
ও ঐ সকল আলেমদের
মাঝে তাওহীদের বিভিন্ন মাসআলা, কুরআন-সন্নাহর অনুসরণ,
মাজহাবী গোঁড়ামি, বিদআত ইত্যাদি অনেক
বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা ও
তর্ক-বিতর্ক হয়।
ফলে মাজহাবের অন্ধভক্ত গোঁড়া আলেম-ওলামা,
সুফি, বিদআতী এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন
একশ্রেণীর নামধারী আলেমদের পক্ষ থেকে তিনি
প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হন। এ
সকল ব্যক্তিরা সাধারণ অজ্ঞ-মূর্খ
লোকদেরকে তার বিরুদ্ধে উত্তেজিত
করে তোলে। তাকে
‘পথভ্রষ্ট ওহাবী’ বলে অপপ্রচার
চালাতে থাকে এবং জনসাধারণকে
শাইখ থেকে সর্তক করতে
থাকে।
Dameske
shara অপরপক্ষে তার
দাওয়াতের সাথে ঐকমত্য পোষণ
করেন দামেস্কের ইলম ও পরহেজগারীতায়
প্রসিদ্ধ স্বনামধন্য আলেম-ওলামাগণ।
তারা শাইখকে তার দাওয়াতের
পথে দৃঢ় কদমে এগিয়ে
যাওয়ার প্রতি উৎসাহিত করেন। সে
সকল ওলামাগণের মধ্যে অন্যতম হলেন:
বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন আল্লামা
বাহজাত আল বাইতার, সিরিয়া
মুসলিম যুব সংঘের প্রধান
শাইখ আব্দুল ফাত্তাহ আল
ইমাম, শাইখ তাওফীক আল
বাযারাহ প্রমুখ।
Dawati
karzokrom খ) প্রতি
মাসে নিয়মিতভাবে তিনি দাওয়াতী সফরে
বের হতেন। প্রথম
পর্যায়ে তিনি মাসে এক
সপ্তাহ দাওয়াতী কাজ করতেন।
পরবর্তীতে তা আরও বৃদ্ধি
পেয়েছিল। তিনি
সিরিয়ার বিভিন্ন জেলায় দাওয়াত নিয়ে
যেতেন। পাশাপাশি
জর্ডানের বিভিন্ন
এলাকায়ও সফর করতেন এবং
অবশেষে তিনি জর্ডানের রাজধানী
আম্মানে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু
করেছিলেন। এই
কারণে তার কিছু দুশমন
সিরিয় সরকারের কাছে তার ব্যাপারে
চুগলখোরি করলে সরকার তাকে
জেলে পাঠায়।
Karaboron ✔ কষ্টে
ধৈর্য ধারণ ও হিজরত:১৯৬০ সালের প্রথম
দিকে শাইখ সিরিয়া ক্ষমতাসীনদের
নজরদারীতে পড়েন যদিও তিনি
রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন। যা
তার সামনে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা
সৃষ্টি করেছিল। তিনি
দুবার গ্রেফতার হয়েছেন। প্রথমবার
৬৮ সালের আগে দামেস্কের
কেল্লা কারাগারে বন্দি ছিলেন একমাসের
জন্য। এটা
সেই কারাগার যেখানে শাইখুল ইসলাম
ইবনে তাইমিয়া (রহ.)কে বন্দি
করে রাখা হয়েছিল।
৬৮ সালের যুদ্ধের সময়
সিরিয় সরকার সকল রাজবন্দীকে
মুক্ত করে দিলে তিনিও
মুক্ত হন।কিন্তু
যুদ্ধ আরও কঠিন রূপ
ধারণ করলে শাইখকে পুনরায়
কারাবরণ করতে হয়।
Jordan
bosobas পরবর্তীতে তিনি
সিরিয়া ছেড়ে জর্ডানে পাড়ি
জমান এবং রাজধানী আম্মানে
স্থায়ী ভাবে বসবাস করেন। মৃত্যু
পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন।
Karzokrom কার্যক্রম
ও অবদান:✔ ২) দামেস্ক
বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীয়া ফ্যাকাল্টির পক্ষ
থেকে তাকে ইসলামী ফিকাহ
কোষ এর বুয়ূ বা
ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত হাদীসগুলো তাখরীজ করার জন্য
মনোনীত করা হয় যা
১৯৫৫ইং সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ
থেকে প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা
হয়। ৩)
মিসর ও সিরিয়া একীভূত
হওয়ার যুগে হাদীসের কিতাব
সমূহ তাহকীক ও প্রচার-প্রসারের নিমিত্তে একটি প্রকল্প হাতে
নেয়া হয়। শাইখকে
এই প্রকল্প তত্ত্বাবধান কমিটির সদস্য হিসেবে
মনোনয়ন দেয়া হয়।
✔ তাঁর
লিখিত কিতাবাদী ও গবেষণা:
শাইখের
অনেক মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বই-পুস্তক ও গবেষণা
কর্ম রয়েছে। সেগুলোর
সংখ্যা শতাধিক। তন্মধ্যে
অনেকগুলোই বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। কোন
কোনটি একাধিক বার মুদ্রিত
হয়েছে। সেগুলো
থেকে নিম্নে গুরুত্বপূর্ণ কিছু
বইয়ের তালিকা প্রদান করা
হল:✔ ১) ইরওয়াউল গালীল
ফী তাখরীজি আহাদীসি মানারিস সাবীল। (নয়
খণ্ডে সমাপ্ত)
২) সিলসিলাতুল আহাদীসিস সাহীহাহ। (সহীহ
হাদীস সিরিজ এবং সেগুলোর
কিছু ব্যাখ্যা ও শিক্ষা।)
(সাত খণ্ডে সমাপ্ত)
✔ ৩)
সিলসিলাতুল আহাদীসিয যাঈফাহ ওয়া মাযূআহ
(দূর্বল ও বানোয়াট হাদীস
সিরিজ এবং মুসলিম উম্মাহর
মধ্যে তার কুপ্রভাব)।
(চৌদ্দ খণ্ডে সমাপ্ত) ✔ ৪)
সাহীহ ওয়া যাঈফ সুনান
আবূ দাউদ (সুনান আবুদাউদের
হাদীসগুলো তাখরীজ এবং তাহকীক
করে সহীহ ও যঈফ
দুভাবে ভাগ করা হয়েছে।) (দশ
খণ্ডে সমাপ্ত)✔ ৫) সাহীহ
ও যাঈফ সুনান নাসাঈ
(সুনান নাসাঈর হাদীসগুলো তাহকীক
করে সহীহ ও যঈফ
দুভাবে ভাগ করা হয়েছে।) (সাত
খণ্ডে সমাপ্ত) প্রমুখ।
✔ আন্তর্জাতিক
বাদশাহ ফায়সাল পুরষ্কার:
ইসলামী
জ্ঞান-গবেষণা ও ইসলামী
শিক্ষার প্রচারে অবদানের জন্য তাকে ১৪১৯
হিজরী মোতাবেক ১৯৯৯ ইং সনে
আন্তর্জাতিক বাদশাহ ফায়সাল পুরষ্কারে
ভূষিত করা হয়।
তার পুরষ্কারের শিরোনাম ছিল: “প্রায় একশ’র অধিক পুস্তক
রচনার মধ্য দিয়ে হাদীসের
তাহকীক, তাখরীজ ও গবেষণা
ইত্যাদি ক্ষেত্রে হাদীসের সেবায় বিশেষ অবদানের
জন্য সিরিয় নাগরিক সম্মানিত
শাইখ মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানীকে এ পুরষ্কারের জন্য
মনোনীত করা হল।”✔ তাঁর ব্যাপারে আলেমগণের
ভূয়সী প্রশংসা:✔ ১) শাইখ আব্দুল্লাহ
বিন বায (রহ.) বলেন:“বর্তমান বিশ্বে আসমানের নিচে
আল্লামা মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানীর মত এত বড়
হাদীসের আলেম আমি দেখি
নি।”শাইখ
বিন বায (রহ.) এর
নিকট এই হাদীসটি সম্পর্কে
জানতে চাওয়া হয়।
যেখানে রাসূল (ﷺ) বলেছেন: “আল্লাহ তায়ালা প্রতি
একশ বছরের মাথায় এই
উম্মতের জন্য এমন একজনকে
পাঠাবেন যিনি দ্বীন-ইসলামকে
সংস্কার করবেন।” তিনি
বলেন: আমার ধারণা, শাইখ
মুহাম্মদ নাসিরুদ্দীন আলবানী হলেন এ
যুগের মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক।
আল্লাহ সব চেয়ে ভাল
জানেন।
Mritto আল্লামা
আলবানী রহ. এর ওফাত
হয়, শনিবার, ২২ জুমাদাল আখেরা,
১৪২০ হিজরী, মোতাবেক ২
অক্টোবর, ১৯৯৯ খৃষ্টাব্দ।
ইশার স্বলাতের পরে তাকে দাফন
দেয়া হয়। দুটি
কারণে শাইখের দাফন তাড়াতাড়ি
দেয়া হয়:যদিও শাইখের
মৃত্যুর সংবাদ নিকটাত্মীয় ও
কাফন-দাফনে সহযোগিতা করার
জন্য বিশেষ কিছু লোককে
ছাড়া অন্য কাউকে দেয়া
হয় নি এবং মৃত্যু
বরণের পর দাফন করতে
তেমন বিলম্বও
করা হয় নি তথাপি
তারা জানাজায় হাজার হাজার মানুষের
সমাগম হয়।
মমিনুল ইসলাম
মোল্লা,লেখক, সাংবাদিত ও গবেষক
No comments